`বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাসের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে`

জগমোহন ডালমিয়ার একান্ত সাক্ষাৎকার

উৎপল শুভ্র

২৬ জুন ২০২১

`বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাসের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে`

জগমোহন ডালমিয়া

এক দিনের ঝটিকা সফরে ঢাকায় আইসিসি প্রেসিডেন্ট জগমোহন ডালমিয়া। উদ্দেশ্য কিছুদিন পরই ঢাকায় অনুষ্ঠেয় এশিয়া একাদশ ও অবশিষ্ট বিশ্ব একাদশের মধ্যকার ম্যাচের প্রস্তুতি সরেজমিনে দেখাটা। ঠাসা সূচি...ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিটিং, ম্যাচের ভেন্যু পরিদর্শন, আরও এটা-ওটা, এরই মধ্যে আবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ। ইন্টারভিউয়ের জন্য সময় বের করা প্রায় অসম্ভবই ছিল। লেগে থাকার কারণে সেই `অসম্ভব`-ও সম্ভব হয়েছিল, তবে ইন্টারভিউটা সারতে হয়েছিল টেলিফোনেই।

প্রথম প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারি ২০০০। প্রথম আলো।

টেলিফোন সাক্ষাৎকার, তারপরও তা স্মরণীয় হয়ে আছে জগমোহন ডালমিয়ার আন্তরিকতায়। পূর্ব পরিচয় ছিল, তারপরও তুমুল ব্যস্ততার মধ্যে সময় বের করা সহজ ছিল না। তা তো বের করেছিলেনই, সময়ও ভালোই দিয়েছিলেন। নইলে কি আর এত সব বিষয় নিয়ে কথা বলা যেত! আইসিসি প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতা, ক্রিকেটের বিশ্বায়ন-দর্শনের ব্যাখ্যা, বিষফণা তুলতে থাকা ফিক্সিং, কদিন আগেই শোয়েব আখতারের বোলিং অ্যাকশন নিয়ে বিতর্ক...এমন আরও কত বিষয়! তবে সব ছাপিয়ে জগমোহন ডালমিয়ার যে কথাটা ইন্টারভিউটাকে বিশেষ করে তুলেছিল, শিরোনামটা করা হয়েছে তা দিয়েই। ডালমিয়া কথাটা বলেছিলেন, 'আপনারা তো টেস্ট স্ট্যাটাসের দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন', আমি 'আপনারা'-কে 'বাংলাদেশ' করে দিয়েছি। ডালমিয়া তো এটাই বলতে চেয়েছিলেন। মাস ছয়েক পর সেই দরজা দিয়ে বাংলাদেশ টেস্ট পরিবারে ঢুকে যাওয়ায় সাক্ষাৎকারটা আরও স্পেশাল হয়ে যায়। সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ:

উৎপল শুভ্র: বাংলাদেশে আপনার এই সফরের উদ্দেশ্য কী?

জগমোহন ডালমিয়া: আমি দেখতে এসেছিলাম। ক্রিকেট উইক উপলক্ষে ৮ এপ্রিল ঢাকায় এশিয়া একাদশ ও অবশিষ্ট বিশ্ব একাদশের মধ্যে একটা ম্যাচ হবে। সেই ম্যাচের জন্য প্রয়োজনীয় সব সুযোগ-সুবিধা আছে কি-না, সে ব্যাপারে জানতে এসেছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছি। অনেকক্ষণ কথা হয়েছে। চার-পাঁচ দিনের মধ্যে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

শুভ্র: ’৯৮-এর অক্টোবরে বাংলাদেশ মিনি বিশ্বকাপ আয়োজন করল। বড় ম্যাচ আয়োজনের সামর্থ্য তো প্রমাণিতই। তাহলে আপনি আর কোন বিষয়ে নিশ্চিত হতে চান?

ডালমিয়া: না, না, মিনি বিশ্বকাপ অন্যরকম ব্যাপার ছিল। সেখানে দলগতভাবে অংশ নিয়েছিল সবাই। কিন্তু এবার এক দলে থাকবে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার খেলোয়াড়রা, অন্য দলের খেলোয়াড় নির্বাচিত হবে বিশ্বের বাকি সব দল থেকে। এই ম্যাচে খেলতে খেলোয়াড়রা আসবে ব্যক্তিগতভাবে, তাই তাদের আসা-যাওয়া এসব ব্যাপারে সমন্বয়ের ব্যাপারটি হবে অন্যরকম।

শুভ্র: তা কথাবার্তা যা বললেন, তাতে কি ম্যাচটি হচ্ছে নিশ্চিত?

ডালমিয়া: এটা এখনই বলতে পারব না। চার-পাঁচ দিনের মধ্যে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে।

এশিয়া একাদশ বনাম বিশ্ব একাদশের ম্যাচটি শেষ পর্যন্ত ঢাকাতেই হয়েছিল। ছবি: ইউটিউব

শুভ্র: বিশ্বজুড়ে ক্রিকেট ছড়িয়ে দেওয়া—এক কথায় গ্লোবালাইজেশনের স্লোগান তুলে আপনি আইসিসির প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তা আপনার লক্ষ্য বা প্রতিশ্রুতি বাস্তবে রূপ নিয়েছে কতটুকু?

ডালমিয়া: কিছুটা তো অর্জিত হয়েছেই। তবে আপনি কোনো কিছুরই তো রাতারাতি অ্যাচিভ করতে পারবেন না। কোনো কিছু চাইলেই একদিনের মধ্যে তা পেয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে কিছু কাজ তো হয়েছেই। এই তো আমরা 'ক্রিকেট উইক' উদযাপন করতে যাচ্ছি, টানা ৩০ ঘণ্টা টেলিভিশনে ক্রিকেট দেখানো হবে। পুরো বিশ্ব ক্রিকেট দেখবে। বলতে পারেন. আমি একটা প্রসেস শুরু করে দিয়েছি। তারপর আইসিসির ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের কথা ধরুন। আপনাদের দলই (বাংলাদেশ) দু'তিন বছর আগে যে ধরনের ক্রিকেট খেলত, তার সঙ্গে এখনকার খেলার নিশ্চয়ই তফাৎ আছে।

শুভ্র: আইসিসি প্রেসিডেন্ট হিসেবে আপনার মেয়াদ তো প্রায় শেষ হতে চলল। আপনি কি তৃপ্ত হয়ে বিদায় নিচ্ছেন?

ডালমিয়া: দেখুন, এর তো কোনো শেষ নেই। এটা একদিন-দুদিনে হওয়ার বিষয়ও নয়। আমার একটাই তৃপ্তি—একটা প্রসেস শুরু করে দিতে পেরেছি। তবে একটাই আফসোস, সবাইকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে কাজ শুরু করতেই বছরখানেক সময় চলে গেছে। নইলে তিন বছর সময় তো একেবারে কম নয়। সবাইকে আমার বোঝাতে হয়েছে এই যে আট-নয়টি দেশ ৯০ বছর ধরে খেলছে, আবার হয়তো ৯০ বছর পর চার-পাঁচটি দেশ যোগ হবে। এভাবে যে হবে না—এই ধারণাটা সবাইকে বোঝাতে পেরে আমি খুশি।

শুভ্র: কিন্তু গ্লোবালাইজেশনের ধাক্কাতেই কিনা অনেকেই অভিযোগ করছেন একটু বেশি খেলা হচ্ছে এখন। আপনি কি একমত?

ডালমিয়া: আমার তা মনে হয় না। বেশি লোককে খেলায় আনতে হলে বেশি খেলা হতে হবে। প্লেয়াররা আসবে-যাবে, কাউকে তো আর ধরে-বেঁধে খেলানো হচ্ছে না। খেলোয়াড়রাও খেলতে চাইছে, খেলতে পারছে বলেই খেলছে। এই যে কাউন্টি ক্রিকেট ৫০ বছর ধরে সপ্তাহে ছয় দিন খেলা হচ্ছে, কই, কেউ তো আপত্তি করছে না। দর্শক খেলা দেখতে আসছে, সংগঠকরাও আয়োজন করতে পারছে, তাহলে সমস্যা কোথায়? আমি বলব, খেলাটা এখন অনেক পপুলার। আগে ক্রিকেট ছিল অভিজাত শ্রেণির খেলা। এখন তা জনগনের খেলায় পরিণত হয়েছে। আপনি দেখবেন, পাড়ায় পাড়ায় রাস্তায় ইট দিয়ে উইকেট বানিয়ে খেলা হচ্ছে এখন। টপ লেভেলে খেলার কথা বাদ দিন, এভাবেও যত লোক খেলায় আসবে, ততই ভালো। খেলায় আসলে মন-মেজাজ ভালো থাকে। আর বিশেষ করে ক্রিকেট, যার অন্য নামই তো 'জেন্টলম্যানস গেম'।

প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন ডালমিয়ার অনেকটা সময় কেটেছে ফিক্সিং-বিতর্ক সামলাতে। ছবি: গেটি ইমেজেস

শুভ্র: কিন্তু এখন যেভাবে ক্রিকেট খেলা হয়, তাতে কী এখনো এটিকে ‘জেন্টলম্যানস গেম’ বলা যায়?

ডালমিয়া: এখনো এটি জেন্টলম্যানস গেমই। অন্য খেলার চেয়ে অনেক বেটার। তবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনেক বেড়েছে। আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা যতই বাড়বে, ততই এক ইঞ্চি ছাড় না দেওয়ার একটা মানসিকতা সৃষ্টি হবেই। তারপরও অন্য খেলার সঙ্গে তুলনা করুন। ফুটবল খেলায় কি চিন্তা করতে পারেন যে, দর্শক খেলা শেষে মাঠে ঢুকে যাচ্ছে। ক্রিকেটে তা হয়, বড় ধরনের কোনো সমস্যাও তো এখন পর্যন্ত হয়নি। আর যারা বেটিং-ম্যাচ ফিক্সিং এসব কথা বলে, তারা তো সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারছে না। কোনো নাম বলছে না। তাই এগুলোকে আমি মনে করি, একটা ব্যক্তিগত প্ল্যাটফর্ম থেকে পাবলিসিটি পাওয়ার চেষ্টা।

শুভ্র: কিন্তু এই বেটিং আর ম্যাচ ফিক্সিংয়ের গুঞ্জন তো খেলাটির ইমেজে কাল লেপটে দিচ্ছে।

ডালমিয়া: এ ব্যাপারে মিডিয়াকেই এগিয়ে আসতে হবে। মিডিয়াকে বলতে হবে, যদি আপনি অভিযোগ করেন, প্রমাণ করতে হবে। নাম বলতে হবে। প্রকাশ্যে নাম বলতে যদি অসুবিধা থাকে, তাহলে মন্ত্রীর কাছে গিয়ে নাম বলো, পুলিশ কমিশনারকে বলো।

শুভ্র: তাহলে আপনার কি ধারণা, এ সব কিছু হচ্ছেই না?

ডালমিয়া: আমি তো খুঁজে পাচ্ছি না। এটা তো ভয়ংকর অভিযোগ। এ রকম একটা-দুটো ইনসিডেন্ট হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু আমি যখন ভারতীয় বোর্ডের সেক্রেটারি ছিলাম, তদন্ত করে কিছুই পাইনি।

সে সময়ের বিসিবি প্রেসিডেন্ট সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে আইসিসি প্রেসিডেন্ট জগমোহন ডালমিয়া। প্রেস কনফারেন্সটা ছিল এশিয়া একাদশ বনাম অবশিষ্ট বিশ্ব একাদশের ম্যাচ নিয়েই। ছবি: এএফপি

শুভ্র: এবার একেবারে সাম্প্রতিক একটি বিষয়। আইসিসির থ্রোয়িং প্যানেল কর্তৃক নিষিদ্ধ শোয়েব আখতারকে খেলায় ফেরার সুযোগ করে দেওয়ায় আপনার তীব্র সমালোচনা হচ্ছে। এটা আপনি কেন করলেন?

ডালমিয়া: আমি কিন্তু কোনো রুলিং দিইনি বা পাকিন্তানের আপিলে সাড়া দিয়েছি, এমন বলিনি। শোয়েবের ব্যাপারে থ্রোয়িং কমিটি যেভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেই প্রোসিডিউরটা ঠিক ছিল না। ওতে ত্রুটি ছিল। ওনারা শোয়েবের বোলিংয়ের পুরো ফুটেজ দেখেননি, শুধু বাউন্সারের ফুটেজ দেখে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ওই কমিটিতে অভিজ্ঞ খেলোয়াড়েরা আছেন, আম্পায়াররা আছেন—আমি তাদের সিদ্ধান্ত ওভার-রুল করিনি। তা করার ক্ষমতা বা অধিকার আমার আছে বলেও মনে করি না। তবে আমার কথা হলো, কাউকে শাস্তি দিতে চাইলে পুরো ব্যাপারটা তো খতিয়ে দেখে নিতে হবে। আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সেটি পুরোপুরিই অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সিদ্ধান্ত, কোনো ক্রিকেটিং বা টেকনিক্যাল সিদ্ধান্ত নয়।

শুভ্র: তাহলে শোয়েব আখতার কি আপাতত শুধু ওয়ানডেই খেলতে পারবেন, টেস্ট ম্যাচ নয়?

ডালমিয়া: আমি ওদেরকে বলেছি, ওয়ানডেতে তো আর বাউন্সার নিয়ে সমস্যা নেই। তাই ও খেলুক। আপনারা ব্যাপারটা ভালো করে দেখুন। কারও বিচার করতে গেলে তো সব কিছু বুঝে নিতে হবে। একজন ক্রিকেটারের ক্যারিয়ার নিয়ে তো আর ছিনিমিনি খেলা যায় না।

শুভ্র: কিন্তু আপনার এই সিদ্ধান্তের কারণে ক্রিকেট বিশ্বে পুরোনো বিভক্তিটা তো আবার মাথাচাড়া দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে, উপমহাদেশ তার শক্তি দেখাতেই এটা করেছে।

ডালমিয়া: না, না, এটা উপমহাদেশের কোনো ব্যাপার নয়। এটা যারা বলছেন, তারা ঠিক বলছেন না। আর এ ধরনের কোনো বিভক্তি আছে বলেও আমার মনে হয় না। 

শুভ্র: আসল প্রশ্নটা শেষে করব বলে রেখে দিয়েছি। আমাদের নিজেদের প্রসঙ্গে আসি। বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাসের যে আবেদন করেছে, আগামী জুনের আইসিসি মিটিংয়ে কি তা গৃহীত হতে যাচ্ছে?

ডালমিয়া: আপনারা তো টেস্ট স্ট্যাটাসের দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। এই স্ট্যান্ডার্ডে গত কিছুদিন অনেক খেলা হয়েছে, সেসবের রেজাল্ট নিয়ে আমরা এই জুনের মিটিংয়ে বসব। আমার মনে হয় স্ট্যান্ডার্ডটাতে পৌঁছে গেছেন আপনারা। আসলে এটা প্রদানের কোনো মাপকাঠি নেই। দেখা যাক, কী হয়!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×