`কঠিন পর্ব শুরু হলো এবার`

সাবের হোসেন চৌধুরীর একান্ত সাক্ষাৎকার

উৎপল শুভ্র

২৬ জুন ২০২১

`কঠিন পর্ব শুরু হলো এবার`

১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি না জিতলে বা বিশ্বকাপে দুটি জয় না পেলে কিছুতেই কিছু হতো না। মূল কৃতিত্বটা তাই অবশ্যই বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের। তবে শুধু পারফরম্যান্স বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশ তখনই টেস্ট স্ট্যাটাস পায় না। এজন্য কৃতিত্ব দিতে হবে বাংলাদেশের ক্রিকেট কর্তাদের ‘ক্রিকেট কূটনীতিকেও। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী এতে রেখেছেন বড় ভূমিকা। আইসিসির নির্বাহী কমিটির সদস্য হওয়ায় এই লক্ষ্য পূরণের জন্য কাজ করতে অনেক সুবিধাও হয়েছে তাঁর। বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়ে যাওয়ার পর লন্ডন থেকে টেলিফোনে দিয়েছিলেন এই সাক্ষাৎকার। যাতে স্বপ্নপূরণের আনন্দের সঙ্গে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন বাড়তি দায়িত্বের কথাও।

প্রথম প্রকাশ: ২৭ জুন ২০০০। প্রথম আলো

উৎপল শুভ্র: অবশেষে টেস্ট স্ট্যাটাস পেল বাংলাদেশ। এটা তো স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতো ব্যাপার।

সাবের হোসেন চৌধুরী: সত্যি তাই। অনেক দিনের স্বপ্ন পূরণ হলো। যতটুকু আশা করেছিলাম, তার চেয়েও ভালোভাবে সব হলো। ইংল্যান্ডকে নিয়ে একটু সংশয় ছিল। শেষ পর্যন্ত ওরাও ভোট দিয়েছে। সর্বসম্মতভাবেই আমরা টেস্ট স্ট্যাটাস পেলাম। একটা পাওয়াই তো বিরাট আনন্দের ব্যাপার, এর সঙ্গে যেভাবে তা পেলাম, তাতে আরও বেশি খুশি।

শুভ্র: আজকের সভায় স্পটলাইটটা তো বাংলাদেশের ওপরই ছিল।

সাবের হোসেন: হ্যাঁ তাই। বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাসটা ছিল মূল এজেন্ডা। প্রথমেই অস্ট্রেলিয়া খুব জোরালভাবে আমাদের পক্ষ সমর্থন করেছে। ইংল্যান্ডের মধ্যে যে দোটানা ভাব ছিল, হয়তো এতেই কেটে গেছে তা। এজেন্ডাটি আলোচিত হয়েছে দুই পর্বে। প্রথমে বাংলাদেশে আইসিসির যে ইন্সপেকশন টিম গিয়েছিল, তাদের রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা হলো। এরপর দ্বিতীয় পর্বে ভোট।

দেশের ক্রিকেটের দিগন্ত বদলে দেওয়া সেই সংবাদ সম্মেলনে বিসিবির সে সময়কার সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী ও আইসিসির সে সময়ের সভাপতি ম্যালকম গ্রে। এই সংবাদ সম্মেলনেই বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদার ঘোষণা এসেছিল। ছবি: শা. হ. টেংকু

শুভ্র: ভোটের আগে টেস্ট স্ট্যাটাসের পক্ষে-বিপক্ষে কি কোনো কথা হয়েছে?

সাবের হোসেন: পক্ষে-বিপক্ষে নয়, এমনিতে আলোচনা হয়েছে। আমরা (বোর্ডে) যে পরিবর্তনগুলো করেছি, এসব করা উচিত বলেছে সবাই। টেস্ট স্ট্যাটাস অর্জন করা অবশ্যই বড় ব্যাপার। তবে একে অর্থবহ করে তুলতে আরও কাজ করতে হবে।

শুভ্র: আনন্দের অনুভূতির সঙ্গে বাড়তি দায়িত্বের চাপটাও কি অনুভব করছেন আপনি?

সাবের হোসেন: তা তো করছিই। আনন্দ আছে, তবে কঠিন পর্ব তো মাত্র শুরু হলো। দায়িত্ব বেড়ে গেল অনেক। এতগুলো দেশ আমাদের সমর্থন করেছে। তাদের আস্থার প্রতিদান তো দিতে হবে। খেলার মাঠে পারফরম্যান্স দিয়ে বোঝাতে হবে তাদের।

শুভ্র: ’৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জয়ের পর আপনি পাঁচ বছরের মধ্যে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। অথচ তা হয়ে গেল তিন বছরের মধ্যেই। এটা তো আপনার প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে গেল!

সাবের হোসেন: আসলে আমরা গোছানোভাবে কাজ শুরু করেছি। গত বছর যে ভোটাভুটি হলো এরপর থেকেই কাজ করেছি আমরা। এ কারণেই আগে যারা বিরোধিতা করেছিল, তারা এবার পক্ষে এসেছে। আমরা আমাদের স্ট্র্যাটেজিও চেঞ্জ করেছি, যে কারণে আইসিসি নতুন করে ভাবতে বাধ্য হয়েছে। আমরা শুধু মাঠের পারফরম্যান্সের ওপর জোর দিইনি, জিম্বাবুয়ে যে রকম বলেছিল আমরা তিনবার আইসিসি ট্রফি জিতেছি আর কি করব! আমরা তা তো বলতে পারছিলাম না। তাই আমরা ফোকাসটা ঘুরিয়ে দিয়েছি অন্য দিকে। জোর দিয়েছি সম্ভাবনার ওপর। নইলে কেনিয়ার সঙ্গে ৬টি ওয়ানডে খেলে আমরা জিতেছি মাত্র ১টিতে। এ কারণেই কৌশল পরিবর্তন করলাম। আমি মনে করি এটি আমাদের বড় এক জয়।

দেশের খেলাধুলার ইতিহাসে টেস্ট মর্যাদা পাওয়া ছিল বিশেষ ঘটনাই। লর্ডসের বাইরে বিসিবির সে সময়কার সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরীকে ঘিরে উৎসুক ক্রিকেটপ্রেমীরা। যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী বাংলাদেশিরাও সেদিন আনন্দে মেতেছিলেন। ছবি: শা. হ. টেংকু

শুভ্র: তাহলে আপনি কি বলবেন টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তিটা আমাদের ক্রিকেট ডিপ্লোম্যাসিরই সাফল্য?

সাবের হোসেন: কিছুটা তো অবশ্যই। কিছু করতে চাইলে আগে তো লক্ষ্য স্থির করতে হবে। আমরা ২০ বছর তো টেস্ট স্ট্যাটাসের জন্য আবেদনই করিনি। আবেদন করার পর আমরা পরিকল্পনা করেছি। কৌশল ঠিক করেছি। মাঠের মতো মাঠের বাইরেও খেলা আছে। সব কিছু মিলেই এটা হয়েছে, এটি সন্মিলিত প্রয়াসের ফসল। যেমন দেখুন, ইউএই যেভাবে অভিবাসীদের খেলিয়ে আইসিসি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হলো, আমরা সেই কোয়ালিফিকেশন রুল চেঞ্জ করলাম। এর মাধ্যমে পথটা পরিষ্কার করলাম। এরপর আমরা আইসিসি ট্রফি জিতেছি। ধীরে ধীরে ঢাকাকে একটি আন্তর্জাতিক ভেন্যু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছি। তখন অনেকে এর সমালোচনা করেছে। কিন্তু এখন সেসবের সুফল পাচ্ছি। বাংলাদেশকে ওভাবে তুলে না ধরলে সবাইকে আজ পক্ষে পেতাম না।

শুভ্র: টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর প্রথম কোন কাজটিকে সবচেয়ে বেশি জরুরি মনে করছেন আপনি?

সাবের হোসেন: অবশ্যই তৃণমূল পর্যায়ে ডেভেলপমেন্টের ওপর জোর দেওয়া। ৬ থেকে ১১ বছর, ১২ থেকে ১৫ বছর, ১৬ থেকে ১৯ বছর—এই তিনটি এজ গ্রুপে অনেক কাজ করতে হবে।

শুভ্র: এসব কথা তো আপনি ’৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জয়ের পরও বলেছিলেন। কিন্তু তিন বছরে সে রকম কিছু তো হয়নি।

সাবের হোসেন: সেভাবে হয়নি, কারণ আমাদের ফোকাসটা ছিল টেস্ট স্ট্যাটাস অর্জন করার দিকে। যদি ওদিকে বেশি চলে যেতাম তাহলে এদিকে হতো না। আমরা চেয়েছি যেভাবেই হোক টেস্ট স্ট্যাটাসটা পেয়ে যেতে। এই বোর্ডের মেয়াদকালেই টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়াটা লক্ষ্য ছিল আমাদের সেটি হয়েছে, এখন বাকি সব কিছু করতে হবে।

টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার খবর পাওয়ার পর আনন্দ মিছিল বেরিয়েছিল বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম থেকে। ছবি: এএফপি

শুভ্র: খুব শিগগিরই বাংলাদেশ প্রথম টেস্ট খেলতে নামবে। পারফরম্যান্স কেমন হবে, তা ভেবে কি আপনি একটু উদ্বিগ্ন?

সাবের হোসেন: না, উদ্বিগ্ন হব কেন? দেখুন, নিউজিল্যান্ডের প্রথম টেস্ট জিততে ২৬ বছর লেগেছিল। আমি নিশ্চিত, আমাদের ২৬ বছর লাগবে না। আমার তো ধারণা, দু'তিন বছর, বড় জোর চার/পাঁচ বছরের মধ্যেই প্রথম টেস্ট জিতবে বাংলাদেশ। তবে সবার আগে মনে রাখতে হবে, আইসিসি সহযোগী সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সেরা হতে ২০ বছর খেলতে হয়েছে আমাদের। সেটি ছিল দ্বিতীয় সারি, সেটিতেই যদি ২০ বছর লাগে, এই পর্যায়ে আরও সময় দিতে হবে।

শুভ্র: টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার অনুভূতিটা কীভাবে বর্ণনা করবেন আপনি?

সাবের হোসেন: এই মুহূর্তে শুধু মনে হচ্ছে এত দিনের পরিশ্রম, এত শ্রম সব কিছু সার্থক হলো। শুধু ক্রিকেট না, সমগ্র জাতির জন্যই এটি বিরাট এক অর্জন। আর একটি ব্যাপার দেখুন, স্বাধীনতার পর আমরা সব মত সব ভেদাভেদ ভুলে এক সঙ্গে আনন্দ করার মতো যে দুটো মুহূর্ত পেয়েছি, সে দুটোই দিয়েছে ক্রিকেট। প্রথমটি আইসিসি ট্রফি জিতে, দ্বিতীয়টি বিশ্বকাপে। একটা খেলা আমাদের এত কিছু দিয়েছে। আর কি চাইতে পারি আমরা?

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×