রাজার মতোই বিদায় রানাতুঙ্গার

উৎপল শুভ্র

১১ আগস্ট ২০২১

রাজার মতোই বিদায় রানাতুঙ্গার

২০০০ সালের এই দিনেই শেষবারের মতো টেস্ট ক্রিকেটের মঞ্চ ছাড়েন রানাতুঙ্গা। ছবি: এএফপি

তাঁর বিদায়ে মানপত্র পাঠ করেছেন টনি গ্রেগ, মানপত্র পড়া হয়েছে তাঁর ক্লাব এসএসসির পক্ষ থেকেও। দেওয়া হয়েছে সম্মাননাও। সব শেষে যখন অর্জুনা রানাতুঙ্গার বলার পালা এল, শুরু করার কিছুক্ষণ পরই তাঁকে থেমে যেতে হলো আবেগের বাঁধভাঙা স্রোতে। স্যাটেলাইট চ্যানেলের পর্দায় দেখা দৃশ্যটুকু সম্বল করেও পরিস্কার বোঝা যাচ্ছিল, পুরো শ্রীলঙ্কার চোখেই তখন জল!

প্রথম প্রকাশ: ১১ আগস্ট ২০০০। প্রথম আলো।

১৯৯৬ বিশ্বকাপের পরের কটি দিন যেন শুধুই শেষ রাতের আধো ঘুম-আধো জাগরণে দেখা ছেঁড়াখোঁড়া এক দুঃস্বপ্ন, ঘুম ভাঙার পরই যা নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করা যায়। ১৯৯৬ বিশ্বকাপের পর জাতীয় 'বীর' অর্জুনা রানাতুঙ্গার পরের বিশ্বকাপ শেষে 'জাতীয় শত্রু'তে পরিণত হয়ে যাওয়াটা যে ছিল শুধুই গুটিকয়েক মানুষের ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার চেষ্টা, সেটি বোঝা গিয়েছিল বেশ কিছুদিন আগেই, তা আরও পরিষ্কার হলো গতকাল শেষ বিকেলে। কলম্বোর সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠে মঞ্চস্থ হলো যে আবেগঘন নাটক, এ রকম কিছু ক্রিকেট মাঠে আর কোনো দিন দেখা গেছে কি না সন্দেহ! শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটে অর্জুনা রানাতুঙ্গা অধ্যায়ের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি হলো যেভাবে, ভবিষ্যতের সব ক্রিকেটার এমন বিদায়বেলার স্বপ্ন দেখবেন এখন থেকে। তাঁকে শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটের 'রাজা' বলতেন অনেকে এবং রাজার মতোই বিদায় নিলেন অর্জুনা রানাতুঙ্গা!

সেই ১৯৮২ থেকে এই ২০০০... নিপুণ এক ঔপন্যাসিকের সাজানো উপন্যাসের প্লটের মতোই উত্থান-পতন আর নাটকীয়তায় সাজানো অর্জুনা রানাতুঙ্গার ক্যারিয়ার নায়কের জন্য শেষটাতেও এর চেয়ে ভালো কিছু লিখতে পারতেন না কোনো ঔপন্যাসিক। দুই ইনিংসে রানাতুঙ্গা করেছেন ৫ ও অপরাজিত ২৮, এমন কোনো রান নয়। তবে শেষ টেস্টের সমাপ্তিলগ্নে তাঁর মাঠে থাকাটাই পরিপূর্ণ করে দিয়েছে দর্শকদের সব আকাঙ্ক্ষা। অপরাজিত ২৮ রানের ইনিংসে ৬টি বাউন্ডারি করতালিতে মুখরিত করে তুলেছে চারপাশ।

রানাতুঙ্গার বিদায়ী টেস্টে। ছবি: ইনস্টাগ্রামতবে বাউন্ডারি নয়, দর্শকদের চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে অন্য একটি দৃশ্য দেখে। তারা শেষবারের মতো চোখ ভরে দেখলেন অর্জুনা রানাতুঙ্গার হেঁটে হেঁটে রান নেওয়া। বাউন্ডারি তো সব ব্যাটসম্যানই মারে, তবে ওই হেঁটে হেঁটে রান নেওয়াটা হয়ে উঠেছিল অনেকটা 'রানাতুঙ্গা স্পেশাল'। জাতীয় বীরকে বিদায় জানানোর সুযোগ দিতে গতকাল চা-বিরতির পরই খুলে দেওয়া হয়েছিল এসএসসির গেট। স্টেডিয়াম ছিল তাই দর্শকে ঠাসা। ম্যাচ শেষে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ানো সেই দর্শকদের তুমুল করতালির মধ্যে ব্যাট উঁচু করে প্যাভিলিয়নে ফিরলেন অর্জুনা রানাতুঙ্গা।

দক্ষিণ আফ্রিকান খেলোয়াড়রা মাঠেই জানিয়ে দিল তাঁদের বিদায়ী শুভেচ্ছা আর ফেরার পথে একের পর এক সহ-খেলোয়াড়, কর্মকর্তা জড়িয়ে ধরলেন বুকে। তাঁদের সবারই চোখ ভেজা, রানাতুঙ্গার চোখেও তখন টলমল করছে জল। চোখের জল আড়াল করতেই পরে বিদায়ী আনুষ্ঠানিকতার পুরোটা সময় সানগ্লাস পরে থাকলেন, তারপরও বারবার কেঁপে কেঁপে ওঠা ঠোঁট দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, ক্রিকেট মাঠের সঙ্গে এত বছরের সম্পর্কের সুতোটা ছিড়ে ফেলার অনুভূতিটা আচ্ছন্ন করে ফেলেছে অর্জুনা রানাতুঙ্গাকে। ক্যামেরার ক্লোজআপ সানগ্লাসের ধার ঘেঁষে নেমে আসা জলের ধারাও দেখাল একবার।

শুধুই বিদায়ের যন্ত্রণা নয়, সহ-খেলোয়াড়দের আবেগঘন আলিঙ্গন আর পুরো শ্রীলঙ্কা জুড়ে ভালোবাসার এমন বাঁধভাঙা প্রকাশটাও হয়তো কাঁদিয়েছে এমনিতে মাঠে বিনাযুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনীরও অধিকার ছাড়তে নারাজ আপসহীন এক যোদ্ধাকে। এই আবেগের প্রদর্শনীই হয়েছে কাল। 'শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটকে অর্জুনা রানাতুঙ্গা যা দিয়েছেন তার কোনো তুলনাই হতে পারে 'না' – বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন সনাৎ জয়াসুরিয়া। রানাতুঙ্গার চোখের আর দোষ কী!

ছবি: এএফপি

ম্যাচ শেষে পুরস্কার বিতরণীর আনুষ্ঠানিকতা শেষে বাকি সবাই অদৃশ্য, পুরো মাঠ জুড়ে তখন শুধুই রানাতুঙ্গা। মাঠেই বিছানো হলো লাল কার্পেট, তার দুপাশে দাঁড়ালেন সাবেক ক্রিকেটাররা। দেওয়া হলো গার্ড অব অনার। বিশ্ব ক্রিকেটের পক্ষ থেকে 'রানাতুঙ্গা প্রশস্তি' পাঠ করলেন টনি গ্রেগ। শুধু অর্জুনা রানাতুঙ্গাকেই নয়. মাঠে উপস্থিত তাঁর পরিবারের প্রতিও শ্রদ্ধা জানালেন সাবেক ইংল্যান্ড অধিনায়ক। সেই শ্রদ্ধা অসাধারণ এক ক্রিকেট পরিবারকে শ্রীলঙ্কাকে চার-চার জন খেলোয়াড় (একজন খেলেছেন শুধু ওয়ানডে, বাকি তিন জন টেস্টও) উপহার দেওয়ার জন্য তাঁর বাবা-মায়ের তো এটি প্রাপ্যই। সেই ছোট্টটি থাকতে যে ক্লাবে খেলে খেলে এতদূর আসা, সেই সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠেই খেলেছেন শেষ টেস্ট, গর্বিত ক্লাবের পক্ষ থেকে পাঠ করা হলো দীর্ঘ এক মানপত্র, দেওয়া হলো সুদৃশ্য এক ট্রফি। শ্রীলঙ্কার খেলা ১০৫ টেস্টের ৯৩টিরই অংশ '৯৬-এর বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়কের হাতে একটা বিশেষ ট্রফি তুলে দিলেন শ্রীলঙ্কান বোর্ডের প্রেসিডেন্টও।

সব শেষে যখন অর্জুনা রানাতুঙ্গার বলার পালা এল, শুরু করার কিছুক্ষণ পরই তাঁকে থেমে যেতে হলো আবেগের বাঁধভাঙা স্রোতে।

স্যাটেলাইট চ্যানেলের পর্দায় দেখা দৃশ্যটুকু সম্বল করেও পরিস্কার বোঝা গেল, পুরো শ্রীলঙ্কার চোখেই তখন জল!

আরও পড়ুন:
অর্জুনা রানাতুঙ্গা ও শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটের 'ফার্স্ট ফ্যামিলি'
নন্দিনী রানাতুঙ্গা: শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটের মা
বিদ্রোহী রানাতুঙ্গার অন্য 'যুদ্ধ'

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×