একবার সংখ্যাগুলো দেখুন...

উৎপল শুভ্র

৩০ আগস্ট ২০২১

একবার সংখ্যাগুলো দেখুন...

পরিসংখ্যান যেমন অনেক কিছু বলে, আবার ধোঁকাও দেয়। টেস্টে ৮ সেঞ্চুরি ও ৩৯.০৪ ব্যাটিং গড় দিয়ে ভিক্টর ট্রাম্পারকে বিচার করতে চাইলেই যেমন আপনি ক্রিকেট মূর্খ বলে বিবেচিত হবেন। ব্র্যাডম্যানের ক্ষেত্রে এই সমস্যা নেই। ব্র্যাডম্যান কী বস্তু ছিলেন, তা বুঝতে পরিসংখ্যানই যথেষ্ট। ব্যাটিংয়ের মতো ভাগ্যনির্ভর অনিশ্চিত একটা কাজকে এমনই দুই আর দুইয়ে চারের মতো বানিয়ে ফেলেছিলেন যে, ভাবলে স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়।

৯৯.৯৪ ব্যাটিং গড়ের মতো ইংল্যান্ডে প্রথম সফরে ব্র্যাডম্যানের দুটি রেকর্ডও একই রকম অমরত্ব পেয়ে গেছে। কোনো দিন ভাঙবে না নিশ্চিত বলেই হয়তো তা নিয়ে সেভাবে আলোচনাই হয় না! এক সিরিজে সর্বোচ্চ রানের (৫ টেস্টে ৯৭৪) রেকর্ডের চেয়েও বিস্ময়কর লিডসে এক দিনে ৩০৯। লাঞ্চের সময় ১০৫ রানে অপরাজিত, চা বিরতির সময় ২২০–টেস্টের প্রথম দিনের দুই সেশনেই সেঞ্চুরি। দিন শেষে ৩০৯ রানে অপরাজিত ব্র্যাডম্যান নাকি বলেছিলেন, 'নাইস ওয়ার্ক আউট ফর টুমরো।’

লিডসে এক দিনে ৩০৯ রান করার পর অভিভূত দর্শকের কারণে ড্রেসিংরুমে ফেরাই কঠিন হয়ে পড়েছিল ব্র্যাডম্যানেরপরের দিন অবশ্য ৩৩৪ করে আউট হয়ে যান। অ্যান্ডি স্যান্ডহামের ৩২৫-কে অতীত করে দিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ স্কোরের নতুন বিশ্ব রেকর্ড। ইংল্যান্ড যাওয়ার আগে অস্ট্রেলিয়ায় শেফিল্ড শিল্ডে ৪৫২ করে গেছেন। টেস্ট ও প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রানের দুটি রেকর্ডই তখন ব্র্যাডম্যানের । একসঙ্গে এই দুটি রেকর্ডের মালিক আর একজনই হতে পেরেছেন। তাঁর নাম ব্রায়ান লারা।

পরিসংখ্যান যেমন অনেক কিছু বলে, আবার ধোঁকাও দেয়। টেস্টে ৮ সেঞ্চুরি ও ৩৯.০৪ ব্যাটিং গড় দিয়ে ভিক্টর ট্রাম্পারকে বিচার করতে চাইলেই যেমন আপনি ক্রিকেট মূর্খ বলে বিবেচিত হবেন। ব্র্যাডম্যানের ক্ষেত্রে এই সমস্যা নেই। ব্র্যাডম্যান কী বস্তু ছিলেন, তা বুঝতে পরিসংখ্যানই যথেষ্ট। ব্যাটিংয়ের মতো ভাগ্যনির্ভর অনিশ্চিত একটা কাজকে এমনই দুই আর দুইয়ে চারের মতো বানিয়ে ফেলেছিলেন যে, ভাবলে স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়। ৩৩৮টি প্রথম শ্রেণীর ইনিংসের ২২১টিতে সেঞ্চুরি পাননি। সেই ইনিংসগুলোর গড় কত, জানেন? ৫৮.২০! যা জ্যাক হবস, ওয়ালি হ্যামন্ড, রণজিৎসিংজি, সিবি ফ্রাই, গ্যারি সোবার্স, ভিভ রিচার্ডস ও জিওফ বয়কটের মতো গ্রেটদের সেঞ্চুরিসহ ব্যাটিং গড়ের চেয়েও বেশি! ১১৭টি ইনিংসে সেঞ্চুরি, সেঞ্চুরি করেই যদি আউট হয়ে যেতেন গড় হতো ৬১.১৪। যেহেতু এর অনেকগুলো ডাবল ও ট্রিপল হয়েছে, একটি কোয়াড্রপলও, গড় দাঁড়িয়েছে ৯৫.১৪ ৷

৪৫২ করার পরে সতীর্থদের কাঁধে...এত সব সংখ্যার ভিড়েও শেষ পর্যন্ত ব্র্যাডম্যানের আসল পরিচয় অবশ্যই ওই ৯৯.৯৪। আশ্চর্যই বলতে হবে, দশমিক-টশমিক সংবলিত জটিল এই সংখ্যাটাই মুখে মুখে ফিরতে ফিরতে পরিণত ক্রিকেটের সবচেয়ে মুখস্থ অঙ্কে। যেটি বলা মাত্র বোঝা হয়ে যায় কার কথা হচ্ছে।

ক্রিকেট বিধাতার আশ্চর্য খেলাই বলতে হবে, ডন ব্র্যাডম্যানের অবিশ্বাস্য ক্যারিয়ারের একমাত্র অতৃপ্তিই কি না শচীন টেন্ডুলকারে এসে পরিপূর্ণতা পেল! ১৯৪৮ সালে ওভালে ব্র্যাডম্যান ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট শুরু করেছিলেন ১০১.৩৯ গড় নিয়ে। শেষ ইনিংসে মাত্র ৪ রান করতে পারলেই ব্যাটিং গড় হতো ঠিক ১০০ । যে অঙ্কটাই ভাবীকালে শচীন টেন্ডুলকারের মহিমা বোঝাতে নিশ্চিত ব্যবহৃত হবে। ১০০ আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরিও হয়তো ৯৯.৯৪ ব্যাটিং গড়ের কাছাকাছি বিস্ময়ই উৎপাদন করবে।

তবে ১০০ সেঞ্চুরি যত বিস্ময়করই শোনাক, একদিন অন্য কেউ তা করেও ফেলতে পারে বললে হাসির রোল উঠবে না। বড়জোর দুঃসাহসী কল্পনা বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু ৯৯.৯৪ এমনই এক বিস্ময় যে, দুঃসাহসী কল্পনাও যেটিকে ছোঁয়ার সাহস পায় না। অস্পর্শনীয় সুউচ্চ এক বেদিতে এটিকে বসিয়ে রেখে এর কতটা কাছাকাছি যাওয়া যায়, যুগে যুগে ব্যাটসম্যানরা সে চেষ্টাই শুধু করে গেছেন। একটা কাষ্ঠদণ্ড হাতে পারফেকশনের এ এক এমন উদাহরণ, যা ছাড়িয়ে গেছে ক্রিকেটের সীমানা। বিখ্যাত অঙ্কবিদ টমাস হার্ডি 'ব্র্যাডম্যান ক্লাস’ বলে একটা টার্ম বের করেছিলেন। যেটি ছিল মানবীয় অন্য সব কীর্তির মানদণ্ড । গ্যালিলিও, নিউটন, আইনস্টাইনরা যেমন স্বীকৃতি পেয়েছিলেন ‘ব্র্যাডম্যান ক্লাস’ বলে!

১৯৩০ ইংল্যান্ড সফরে ওই ধ্বংসযজ্ঞ দেখার পর শুধু ব্র্যাডম্যানকে ঠেকাতেই বডিলাইন বোলিংয়ের জন্ম। লেগের দিকটা ফিল্ডারে জনাকীর্ণ করে ব্যাটসম্যানদের শরীর তাক করে ক্রমাগত আক্রমণ। হ্যারল্ড লারউড নামে আগুনে গোলা হাতে থাকায় ডগলাস জার্ডিন সেই কৌশলে সফলও হন। ওই একটা সিরিজেই ব্র্যাডম্যান ‘ব্যর্থ’। ব্যর্থ, কারণ তাঁর গড় নেমে এসেছিল ৫৬.৫৭-তে। যে গড় অন্য সব ব্যাটসম্যানকে গ্রেটনেসের স্বীকৃতি দেয়।

বিশ্বযুদ্ধের কারণে ক্যারিয়ারের সোনালি সময়ের আটটি বছর ঝরে গেছে। যুদ্ধের পর আর খেলারই কথা ছিল না। শরীর অনেক দিনই বেগড়বাই করছিল, ডাক্তাররাও নিষেধ করেছিলেন। তারপরও ব্র্যাডম্যান খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন একটা কারণেই। যুদ্ধের কালো ছায়ায় আচ্ছন্ন ক্রিকেট-বিশ্বকে একটু আলোকিত করার দায় বোধ করেছিলেন বলে। আট বছর বিরতির পর ৩৮ বছর বয়সে ফিরে জীবনের শেষ তিনটি সিরিজে তাঁর ব্যাটিং গড় ৯৭.১৪, ১৭৮.৭৫ ও ৭২.৫৭! যুদ্ধের পর ১৫ টেস্টে ৮টি সেঞ্চুরি! যত ভাবা যায়, বিস্ময় ততই ছেয়ে ফেলে। এ কীভাবে সম্ভব! হাজারো ব্র্যাডম্যান-বন্দনার মধ্যে ইংলিশ ব্যাটসম্যান ডেনিস কম্পটনই বোধ হয় বলেছেন আসল কথাটা, ‘ব্র্যাডম্যান ওয়াজ আ প্লেয়ার হু অ্যাপিয়ারস নট জাস্ট ওয়ানস্ ইন আ লাইফটাইম, ওয়ানস্ ইন দ্য লাইফ অব আ গেম।'

এহেন ব্র্যাডম্যানের সঙ্গে টেন্ডুলকারের তুলনা করা হচ্ছে, এটাই বোধ হয় টেন্ডুলকারের ক্রিকেট-জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। সেটি কি ব্র্যাডম্যান নিজেই টেন্ডুলকারের মধ্যে নিজেকে দেখেছিলেন বলে? টেন্ডুলকারকে নিয়ে ‘ব্র্যাডম্যান’ ‘ব্র্যাডম্যান' রবটার শুরু তো তখন থেকেই। তবে আলোচনাটা তখন 'ব্র্যাডম্যানের পর সেরা কি না' এতেই সীমাবদ্ধ ছিল। যেটির তুঙ্গ ছোঁয়া ১৯৯৮ সালে শারজায় কোকাকোলা ট্রফিতে দুই দিনের ব্যবধানে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেন্ডুলকারের অবিশ্বাস্য দুটি ইনিংসের পর। এর প্রথমটি ‘স্যান্ডস্টর্ম টন' নামে বিখ্যাত হয়ে আছে। ভারত-অস্ট্রেলিয়া সেই ম্যাচের আগেই অস্ট্রেলিয়া ফাইনালে উঠে গেছে। প্রশ্ন তখন প্রতিপক্ষ নিয়ে ভারত না নিউজিল্যান্ড? অস্ট্রেলিয়া ২৮৪ করার পর সমীকরণটা দাঁড়াল এরকম—জিতলে তো কথাই নেই, ২৫৪ করলেও ফাইনালে উঠে যাবে ভারত। বিশ মিনিট খেলা বন্ধ করে দিয়ে সমীকরণটা কঠিন থেকে কঠিনতর করে ফেলে এক মরুঝড়। টেন্ডুলকারের ব্যাটিং-ঝড় সেটিকেও সহজ বানিয়ে ছাড়ে। অতি বড় শত্রুও যার ব্যাপারে অতিশয়োক্তির দুর্নাম করতে পারবে না, সেই রিচি বেনো পর্যন্ত টেন্ডুলকারের ওই ১৩১ বলে ১৪৩ রানের ইনিংসে উচ্ছ্বাসে ভেসে যান, ‘উই হ্যাভ শিন ওয়ান অব দ্য গ্রেটেস্ট ইনিংস অব আওয়ার টাইম।'

ডনের বাড়িতে শচীন...

এক দিন পর ফাইনাল, ঘটনাচক্রে টেন্ডুলকারের ২৫তম জন্মদিনও। ১৩১ বলে ১৩৪ রানের আরেকটি ক্লাসিক উপহার দিয়ে বলতে গেলে একাই হারিয়ে দেন অস্ট্রেলিয়াকে। পরপর দুই ম্যাচে প্রমত্ত টেন্ডুলকারকে দেখে অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ রায় দিয়ে দেন, 'ডন সেরা, কোনো সন্দেহ নেই। তবে এর পরই শচীন ওকে বলা যায় "আমাদের সময়ের ব্র্যাডম্যান”।' এই ফাইনাল শেষে অভাবনীয় একটা দৃশ্যের সাক্ষী টেন্ডুলকারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও মারাঠি ক্রিকেট লেখক দ্বারকানাথ সঙ্গগিরি। ভারতীয় ড্রেসিংরুমে শেন ওয়ার্ন। জার্সি খুলে তাতে টেন্ডুলকারের অটোগ্রাফ চাইছেন।

টেন্ডুলকার জানতে চাইলেন, 'এটা কার জন্য?' ওয়ার্ন বলেন, 'অবশ্যই আমার জন্য।'

টেন্ডুলকার অবাক হয়ে দেখেন, জার্সিতে অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য ওয়ার্নের পেছনে লাইন দিয়ে দাঁড়ানো অস্ট্রেলিয়ার আরও ছয় ক্রিকেটার! ব্র্যাডম্যান বিশ্ব ক্রিকেটেরই সম্পত্তি, তবে প্রথমে তো অস্ট্রেলিয়ার। ‘ব্র্যাডম্যানের পর সেরা’ রবটাও অস্ট্রেলিয়া থেকেই জোরেশোরে ওঠায় সেটি বাড়তি মূল্য পেয়েছিল। টেন্ডুলকারের বিদায়বেলায় সেটি যে ব্র্যাডম্যানের সঙ্গে তুলনায় রূপান্তরিত হয়ে গেল, তাতে আবেগের অবশ্যই বড় ভূমিকা। যেটি শুনলে ইয়ান চ্যাপেল নির্ঘাত খুব রেগে যাবেন।

*লেখকের 'শচীন রূপকথা' বই থেকে।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×