স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০:৩২

রমন লাম্বা: ট্র্যাজেডির নায়ক ক্রিকেটের এক ফেরিওয়ালা

দুলাল মাহমুদ

৬ সেপ্টেম্বর ২০২১

রমন লাম্বা: ট্র্যাজেডির নায়ক ক্রিকেটের এক ফেরিওয়ালা

স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০ বেছে নিতে গিয়ে শুধু বাংলাদেশের কীর্তিমান খেলোয়াড়দেরই বেছে নেওয়া হয়নি, বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে নাড়া দেওয়া ঘটনা-আয়োজন-বিদেশি খেলোয়াড় সবই এসেছে বিবেচনায়। এই পর্বই যেমন ভারতীয় ক্রিকেটার রমন লাম্বাকে নিয়ে, ঢাকাই ক্রিকেটে আলোড়ন তুলে ঢাকার মাঠেই জীবন দিয়ে গেছেন যিনি।

রমন লাম্বাক্রিকেটকে তিনি অসম্ভব ভালোবাসতেন। তেমনটা হয়তো অনেকেই বাসে। কিন্তু তাঁর ভালোবাসার ধরনটা ছিল আলাদা। তিনি প্রায়শই মজা করে বলতেন, তাঁর প্রথম প্রণয় ক্রিকেটের সঙ্গে। দ্বিতীয় স্থানে তাঁর স্ত্রী। এই বাস্তবতাকে মেনে নেন তাঁর গৃহিণী কিম। না মেনে তো উপায় ছিল না। আইরিশ এই ভদ্রমহিলা তো ভালোবেসেছিলেন যাযাবর এক ক্রিকেটারকে। ইচ্ছে থাকলেও তাঁকে বেঁধে রাখতে পারতেন না। খুব একটা কাছেও পেতেন না। তবে বিরহবেদনা থাকলেও দুজনের মধ্যে ভালোবাসার কোনো কমতি ছিল না। 
প্রথম ভালোবাসাই রমন লাম্বার জীবন কেড়ে নেবে, এত তাড়াতাড়ি চিরতরে দুজনকে আলাদা করে দেবে, এমন ভাবনা তো দূরে থাক, কিমের তা কল্পনাও করতে পারার কথা নয়। অনেক স্বপ্ন নিয়ে দিল্লিতে একটু একটু করে গড়ে তোলা ভালোবাসার নিকেতনে থিতু হতে চেয়েছিলেন, সেই স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি। লাম্বা এমন একটা গন্তব্যে স্থিত হয়েছেন, যেখান থেকে কেউ আর ফিরে আসে না।  

এটা তো চিরায়ত কথা, গভীর ভালোবাসার কাছে সবকিছু তুচ্ছ হয়ে যায়। জীবন দিয়ে সেটা প্রমাণ করে দেন লাম্বা। তিনি ছিলেন দুঃসাহসী এক প্রেমিক। ভালোবাসার জন্য নিজেকে উজাড় করে দিতে প্রস্তুত। যে কারণে খেলতে নামলে কোনো কিছুর পরোয়া করা তাঁর ধাতে ছিল না। ক্রিকেটকে জেনেছিলেন জীবনের পরম এক সত্য হিসেবে। তাতেই নিজেকে নিবেদন করেন। তাঁর মাঝে দেখতে পাওয়া যেত আত্মবিশ্বাসী, লড়াকু ও সাহসী একজন ক্রিকেটারের প্রতিকৃতি। ক্রিকেটকে গভীরভাবে ভালোবেসে নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিয়ে ইতিহাস হয়ে আছেন রমন লাম্বা।

তিনি ছিলেন ক্রিকেটের ফেরিওয়ালা। খেলার জন্য ছুটে যেতেন দূরে দূরে৷ ভারত, আয়ারল্যান্ডের পর অনেক দিন খেলেছেন বাংলাদেশে। এই দেশের সঙ্গে গড়ে উঠে তাঁর আত্মিক বন্ধন। অতিথিপরায়ণ এ দেশটাকে তিনি ভালোবেসে ফেলেন। তাঁর হৃদয়ে স্থান করে নেয় এই দেশের ক্রিকেট ও ক্রিকেটানুরাগীরা। অনেকের সঙ্গেই গড়ে উঠে বন্ধুত্বের সম্পর্ক। আমন্ত্রণ পেলে ছুটে আসতে একটুও দ্বিধা করতেন না। নব্বই দশকের শুরু থেকে যে নিবিড় সংযোগ, তার যবনিকাপাত হয় মৃত্যুতে। 

আসলেই কি যবনিকাপাত হয়? বরং বাংলাদেশের ক্রিকেটের সঙ্গে তাঁর বন্ধন চিরস্থায়ী হয়ে আছে। তিনি চলে গিয়েও অনেক বেশি জড়িয়ে আছেন। তাঁকে কখনো ভোলা যাবে না। তাঁর নামে কোনো স্মৃতিচিহ্ন না থাকলেও তিনি সমুজ্জ্বল আছেন অনেকের হৃদয়ে। ক্রিকেটের ইতিহাসের পাতায় চিরকাল তাঁর নাম খোদাই হয়ে থাকবে।

এমন হেলমেট ছাড়াই ব্যাটসম্যানের নিঃশ্বাস ফেলা দূরত্বে ফিল্ডিং করতেন অসমসাহসী লাম্বা। এটাই কাল হলো তাঁর জন্য। ছবি: সংগৃহীত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে হয়তো সেভাবে উদ্ভাসিত হতে পারেননি লাম্বা। সম্ভাবনার যে ঝিলিক তিনি দেখান, তা কেন যেন পরিপূর্ণতা পায়নি। পাননি ভাগ্যের আনুকূল্যও। ১৯৮৬ সালে সফরকারী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে চারমিনার চ্যালেঞ্জ কাপে তিনি ঝলসে ওঠেছিলেন। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে ৬ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ ৩-২-এ জয় করে ভারত। সর্বাধিক ২৭৮ রান করে 'প্লেয়ার অব দ্য সিরিজ' হন তিনি। এই সিরিজ ছাড়া তিনি নিজেকে তেমনভাবে উদ্ভাসিত করতে পারেননি। মাত্র চার টেস্ট আর ৩২টি ওয়ানডে ম্যাচেই থেমে যায় তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। যা তাঁর ক্রিকেটীয় প্রতিভার সঙ্গে একদমই মানানসই নয়। তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে দারুণ পারফরম্যান্সে সেই প্রতিভার প্রমাণ মেলে।

বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের সূত্রপাত হয় ১৯৯০ সালে। সৈয়দ কিরমানির নেতৃত্বে হায়দরাবাদ ডেকান ব্লুজের হয়ে খেলতে এসে দর্শকদের মন জয় করে নেন। শুরু করেন অপরাজিত ৯৭ রানের ইনিংস দিয়ে। তারপর তাঁর ব্যাট থেকে এসেছে তিনটি শতক। এর মধ্যে আছে তিন দিনের ম্যাচে জোড়া সেঞ্চুরি। তাঁর মারকুটে ব্যাটিং দেখে আবাহনী লিমিটেড তাঁকে ঢাকায় খেলার আমন্ত্রণ জানায়। তাতে সাড়া দিয়ে পরের মৌসুমেই আবাহনীর হয়ে দামাল সামার ক্রিকেট দিয়ে শুরু করেন ঢাকা মিশন। প্রথম ম্যাচেই অ্যাজাক্সের বিপক্ষে অপরাজিত ১১০ রানের ইনিংস খেলে তাঁর আগমনী বার্তা জানিয়ে দেন। কোয়ার্টার ফাইনালে উদিতির বিপক্ষে ঝড়ো গতিতে ১০০ এবং সেমিফাইনালে গুলশান ইয়ুথের বিপক্ষে অপরাজিত ১৩৭ রান করে তিনি বুঝিয়ে দেন তাঁর ঘরানা। আবাহনীর শিরোপা জয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার পাশাপাশি হয়েছেন 'ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট'। 

এরপর থেকে ঢাকার ক্রিকেটকে বিনোদিত করার অন্যতম শো-ম্যান হয়ে উঠেন রমন লাম্বা। তিনি মাঠে নামলেই তাঁর কাছে দর্শকদের প্রত্যাশা থাকত বড় ইনিংস। সেই প্রত্যাশা বেশির ভাগ সময়ই পূরণ করেছেন তিনি। মূলত রান করাটাই ছিল তাঁর জীবন, জীবিকা ও আনন্দ। তবে দলের প্রয়োজনে তিনি নিজেকে নিংড়ে দিতেন। ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি কখনও বোলার হিসেবে, কখনও ফিল্ডার হিসেবে, কখনও পরামর্শক হিসেবে। সে বছর বিজয় দিবস ক্রিকেটের ফাইনালে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের বিপক্ষে ১১১ রানের ইনিংস খেলে কঠিন ম্যাচটিকে যেভাবে সহজ করে দেন, তা ছিল দেখার মতো। আবাহনীর শিরোপা জয়ে বড় ভূমিকা রাখে এই ইনিংস। 

সেই মৌসুমে লিগেও তাঁর ব্যাটে ছিল রানের ফোয়ারা। তিনটি শতক ও পাঁচটি অর্ধ-শতকসহ সর্বাধিক ৭৩১ রান করেন। এমন দাপট দেখানোর পরও লিগ শিরোপা জিততে না পারা আবাহনী তাঁর প্রতি কেন যেন আগ্রহ দেখায়নি। যে কারণে পরের মৌসুমে জিএমসিসির হয়ে খেলেন তিনি। যথারীতি তাঁর ব্যাটে রানের ফুলঝুরি। লিগে আবাহনীর শ্রীলঙ্কান মারকাটারি ব্যাটসম্যান আথুলা সামারাসেকেরার পর দ্বিতীয় সর্বাধিক রান ছিল তাঁর। একটি শতক ও ১০টি অর্ধ-শতকসহ লাম্বার সংগ্রহ ছিল ৮২৩ রান। সামারাসেকেরা করেছিলেন ৮৮৯ রান। 

চেহারা-ছবি, চালচলনের সঙ্গে ড্যাশিং ব্যাটিং মিলিয়ে রমন লাম্বা ছিলেন অপ্রতিরোধ্য এক প্যাকেজ

জিএমসিসির হয়ে দ্বিতীয় মৌসুমে তেমন একটা সুবিধা করতে না পারলেও ৩৩৮ রান করেছিলেন। ব্যাটে ঝড় তোলার পাশাপাশি বল হাতেও দেখিয়েছেন মাঝে মধ্যেই চমক দেখিয়েছিন। ফিল্ডার হিসেবেও ছিলেন দুর্দমনীয়। তাঁর খেলা দেখাটা ছিল আনন্দদায়ী এক অভিজ্ঞতা। ঘরোয়া ক্রিকেটে বিদেশিদের মধ্যে তিনি আলাদা একটা অবস্থান গড়ে নিতে সক্ষম হন। বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে যাঁরা সহায়ক শক্তি হিসেবে অবদান রেখেছেন, নিঃসন্দেহে তিনি তাঁদের অন্যতম। 

রমন লাম্বা জীবনের শেষ ইনিংস খেলেছেন আবাহনীর হয়ে। এটা তাঁর খেলার কথা ছিল না। নিয়তি যেন তাঁকে দিয়ে এই ইনিংসটি খেলিয়ে নেয়। বছর দুয়েক পর বিরতি দিয়ে ১৯৯৮ সালে ঢাকা প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগে আবাহনীর হয়ে খেলতে আসেন। কথা ছিল, এক ম্যাচ খেলে চলে যাবেন। নির্ধারিত সেই ম্যাচে কলাবাগানের বিপক্ষে ভালো স্কোর করতে পারেননি। তাঁকে মোহামেডানের বিপক্ষে পরের ম্যাচটি খেলার অনুরোধ জানানো হয়। রমন লাম্বা তাতে রাজি হয়ে যান। বোধ করি অদৃষ্ট তাঁকে খেলতে প্ররোচিত করে। 

সে সময়কার পিজি হাসপাতাল থেকে রমন লাম্বার মরদেহ বের করে নিয়ে আসছেন আবাহনীর কর্মকর্তারা

২০ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে প্রথম পর্বের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে মোহামেডানের বিপক্ষে দলের হয়ে দ্বিতীয় সর্বাধিক ৪৩ রানের ইনিংস খেলেও সন্তুষ্ট হতে পারেননি। ফিল্ডিংয়ে সেটা পুষিয়ে দেওয়ার তাগিদ অনুভব করেন। মোহামেডানের ১৪তম ওভারে স্ট্রাইকে থাকা ব্যাটসম্যান মেহরাব হোসেন অপি। নন-স্ট্রাইকিংয়ে অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল। বল করেন বাঁহাতি স্পিনার সাইফুল্লাহ খান জেম। সিলি মিড অনে ছিলেন লাম্বা। ব্যাটসম্যানের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য তিনি ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নেন। এমনটা তিনি অহরহই করেছেন। তারপরও সেদিন আম্পায়ার অশোকা ডি সিলভা তাঁকে হেলমেট পরতে এবং উইকেটকিপার খালেদ মাসুদ পাইলট আরেকটু দূরে সরে দাঁড়াতে অনুরোধ জানান। 

কিন্তু তিনি যেন মৃত্যুর হাতছানিতে তাঁদের অনুরোধ উপেক্ষা করেন। ১৩.৪ ওভারে জেমের একটা লুজ বলকে অপি পুল করলে তা সরাসরি লাম্বার মাথার বাঁ পাশে আঘাত করে। বলটি বাউন্স করে পাইলটের হাতে ধরা পড়ে। ফিরে যান অপি। আঘাত পেয়ে মাটিতে পড়ে যান লাম্বা। কিছুক্ষণ পর নিজেই হেঁটে হেঁটে মাঠের বাইরে চলে যান। এরপর আর কখনো মাঠে ফিরতে পারেননি। জানতেও পারেননি শেষ ম্যাচে তাঁর দলের জয়ের খবর। জীবন-মৃত্যুর দোলায় দুলতে দুলতে ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকেলে মাত্র ৩৮ বছর বয়সে পাড়ি জমান অনন্তধামে।  

জীবনে অনেক বড় বড় ইনিংস খেলেছেন রমন লাম্বা। কিন্তু নিজের জীবনের ইনিংসটাকে তিনি বড় করতে পারেননি। পারবেন কীভাবে? সেটা তো আর তাঁর এখতিয়ারে ছিল না। তবে তিনি তুমুলভাবে নাড়া দিয়ে যান ক্রিকেট বিশ্বকে। বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসের দিকে পেছন ফিরে তাকালে চোখের সামনে ভেসে উঠে পরিপূর্ণ একজন ক্রিকেটার রমন লাম্বার প্রতিচ্ছবি। তাঁর ঠোঁটে লেগে থাকা মায়াবী মৃদু হাসিটুকু হয়ে আছে অমলিন।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×