বোল্ট-অঁরি-এনটিনি সবারই তো একই অভিজ্ঞতা

কাশীনাথ ভট্টাচার্য

১৩ নভেম্বর ২০২১

বোল্ট-অঁরি-এনটিনি সবারই তো একই অভিজ্ঞতা

প্রকৃতিদত্ত গায়ের রঙের জন্য কত অপমান, কত গঞ্জনা! যেখানে এসে মাইকেল হোল্ডিংয়ের সঙ্গে মিলে যান উসাইন বোল্ট, মাখায়া এনটিনি, থিয়েরি অঁরির মতো বিখ্যাতও। তাঁদের সেসব অভিজ্ঞতাও আছে `হোয়াই উই নিল, হাউ উই রাইস` বইয়ে। ধারাবাহিক রচনার দ্বিতীয় পর্ব।

ক্রিকেটে বৃষ্টি-বিঘ্নিত বিরতি বড় বিরক্তিকর। বিশেষত দর্শকের চোখে। টেলিভিশনের পর্দাজুড়ে আচ্ছাদিত পিচের ওপর জলের অবিরাম বর্ষণ, মাঠের দর্শক ছাদের তলায় নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে, ভিজতে না-চেয়ে। কিন্তু এই বৃষ্টিবিঘ্নিত এক সকালই স্কাই স্পোর্টস-এর পরিচালকদের দিয়েছিল এক অন্য সুযোগ। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু ঘিরে ছোট তথচিত্র দেখানোর। হোল্ডিং সেখানে একা একাই বলে চললেন তাঁর যন্ত্রণার কথা। যা তিনি সয়েছেন। বুকে বয়েছেন।

আগে মুখ খোলেননি, মধ্যবিত্তের আপাত-নিরাপত্তার বলয়ে থাকতে চেয়ে। ওর সঙ্গে যা হয়েছে, আমার সঙ্গে তো হয়নি! তিনি আসলে চোখ ঠেরে থাকতে শিখেছিলেন। তাঁকে শেখানো হয়েছিল। যেটুকু অনাচার অবিচার দেখেছিলেন, সরিয়ে রেখেছিলেন পাশে। লিখেছেন, ’মনে হতো, আমার কী? খেলাটা শেষ হলেই প্লেনে উঠে পৌঁছে যাব জ্যামাইকায়।’ অবচেতনে ভয় ছিল কি? যদি প্রতিবাদ করেন, চিহ্নিত হয়ে যাবেন, বাদ পড়ে যাবেন, কালো হিসাবে দাগিয়ে দেওয়া হবে, কাজ পাবেন না। তিনি যা বলতে চান, যেভাবে বলতে চান, শোনা হবে না। তেমনই যে দস্তুর।

গায়ের রঙের জন্য কত কিছু সইতে হয়েছে বলতে বলতে নিজেকে আর সামলাতে পারেননি মাইকেল হোল্ডিং

ঠিক যা ঘটেছে অ্যাডাম গুডস-এর ক্ষেত্রে। অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের বংশধর তিনি, অশ্বেতাঙ্গ। তাই তাঁকে অস্ট্রেলিয়ান ফুটবল খেলতে দেখে বছর তেরর এক শ্বেতাঙ্গ কিশোরী বলে ফেলে, ‘গুডস, তুমি একটা বাঁদর’! অ্যাডাম দেখে ফেলেন সেই কিশোরীকে, বলতে শোনেন তাঁর গায়ের রঙ নিয়ে চরম অপমানজনক সেই কথা। কাছে-থাকা নিরাপত্তারক্ষীকে দেখিয়েও দেন, যারা বের করে নিয়ে যায় সেই কিশোরীকে। শুরু হয় শ্বেত-অত্যাচার!

কিশোরীর মা বলে ফেলেন, ‘তের বছর বয়স। ছোট শহরের বাসিন্দা। তেমন বেরোয়ও না বাড়ি থেকে। কী বলতে কী বলে ফেলেছে, নিজেও জানে না।’ হয়ত সত্যিই জানে না। কিন্তু মায়ের দোষ ঢাকার চেষ্টা শুধু নয়, মেয়ে আদৌ যে দোষ করেছে সেটাও মানতে না-চাওয়ার ইচ্ছেই প্রকট করে দেয়, কীভাবে শাক দিয়ে মাছ ঢেকে আসছে শ্বেতাঙ্গ সমাজ। কী আর এমন বলেছে একটা কমবয়সী মেয়ে যে এত বড় এক খেলোয়াড়কে এভাবে বর্ণবিদ্বেষের চেহারা দিতে হবে? কলিংউড ক্লাবের সভাপতি এডি ম্যাকগুইর সেই দিন অ্যাডামের কাছে ক্ষমা চাইলেও চার দিন পরই মেলবোর্নের এক রেডিও স্টেশনে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে অ্যাডামের সঙ্গে তুলনা টেনেছিলেন ‘কিংকং’-এর! অস্ট্রেলীয় মিডিয়ায় একঘরে করে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। সেরা অস্ট্রেলীয় হিসাবে বন্দিত ছিলেন যিনি ২০১৪ সালে, ২০১৫-র শেষে বাধ্য হয়েছিলেন খেলা ছেড়ে দিতে। যে মাঠে যাচ্ছিলেন খেলতে, দর্শকদের বিদ্রুপের শিকার হতে হয়েছিল। ভাবখানা এমন, ‘তুই একটা বাঁদর হয়ে ফুলের মতো শ্বেতাঙ্গ তেরর কিশোরীকে মাঠ থেকে বের করে দেওয়ার সাহস দেখালি?’

যাঁরা এখনও ভাবেন, কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ বিখ্যাত হলেই আর থাকে না বর্ণবিদ্বেষের বিষময় সমস্যা, হোল্ডিং তাঁর বইতে লিখেছেন সেই বিখ্যাত কালো মানুষদের কথাই। নিজে জ্যামাইকার লোক, বছর তিরিশের ছোট আর এক জ্যামাইকানকে হাজির করেছেন বই-এর শুরুতেই।

উসাইন বোল্টের বয়স তখন কুড়ি। লন্ডনে গিয়েছিলেন প্রতিযোগিতায় দৌড়তে। ফাঁকা সময়ে শপিং। মলে ঢোকার খানিক পরেই বুঝতে পারেন তাঁকে এক নিরাপত্তারক্ষী ‘ফলো’ করছেন। কেন, বুঝতে পারেননি বোল্ট। ঘড়ির প্রতি ভালবাসা ছোট থেকেই। এক দোকানে ঢুকে দেখতে দেখতে একটি ঘড়ি পছন্দ হয়েছিল। দেখাতে বলেন। সেলসগার্ল-এর সন্দিগ্ধ চাউনি। ‘ওই ঘড়িটা? ওটার দাম কিন্তু বড্ড বেশি। আপনি কি মনে করেন এত দামী ঘড়ি কিনতে পারবেন?’ দেখানোর আগেই এই সন্দেহ! বোল্ট ততক্ষণে বুঝে গিয়েছেন এই সন্দেহের কারণ তাঁর গায়ের কালো রং। কালো মানুষ আবার এত দামী ঘড়ি কিনবে কী করে, ভাবনা থেকে উদ্ভুত এই দ্বিধা। কারণ, কালো মানুষরা তো আর এতটা ধনী হয় না! যদি হয়ও বা, নিশ্চয়ই চুরি-ডাকাতি ছিনতাই-রাহাজানির সঙ্গে যুক্ত। রাস্তায় কাউকে মেরে পাউন্ড চুরি করে এনেছে নির্ঘাত!

উসাইন বোল্টকেও সইতে হয়েছে এই যন্ত্রণা

অনুরূপ ঘটনা হোল্ডিং-এর সঙ্গেও, একই শহরে, চল্লিশ বছরেরও বেশি আগে। দুই কালো মানুষই তাঁদের প্রতি অনাস্থা প্রদর্শনে উন্মুখ সেলসগার্ল-এর সঙ্গে কোনও রকমের দরাদরি না করে একটু বেশি দামেই কিনেছিলেন ঘড়ি। শ্বেতাঙ্গিনীকে মনে মনেও ‘বলেই ছিলাম তো, এত দামী ঘড়ি ওর জন্য নয়’ ভেবে বিদ্রুপের হাসির সুযোগ দিতে চাননি। কালো মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ওপর এই অবিশ্বাসও আসলে বর্ণবিদ্বেষ যার শিকড় ছড়িয়ে রয়েছে সাদা দুনিয়ার প্রতিনিধি মানুষদের মনে, হাজার হাজার বছর ধরেই। অবচেতনে? না, সচেতনেই। কারণ, তাঁদের শেখানো হয়েছে তেমন। শিখিয়েছে সেই শিক্ষা ব্যবস্থা যা প্রতিপদে হেয় করেছে কৃষ্ণাঙ্গ দুনিয়াকে।

মাখায়া এনটিনির ঘটনা তো হৃদয়বিদারক। ম্যাচের দিন সকালে তিনি টিমবাসে উঠতেন না। মাঠে পৌঁছতেন হোটেল থেকে দৌড়ে দৌড়ে। ওই বাসে, যেখানে তাঁর সতীর্থরা হইহুল্লোড় করে মাঠে যেতেন, উঠলেই মনটা বিষিয়ে যেত এনটিনির। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার। তাই শ্বেতাঙ্গ সতীর্থরা আচার-আচরণে বুঝিয়ে দিত, সেই দলে তিনি অপাঙক্তেয়। ব্রেকফাস্টের জন্য খাওয়ার জায়গায় গিয়ে এনটিনি আবিষ্কার করতেন, তাঁর টেবিল ফাঁকা থাকা সত্ত্বেও কোনও শ্বেতাঙ্গ ক্রিকেটার এসে বসছেন না। একা একাই সকালের খাবার খেয়ে ফিরে আসতেন ঘরে, একাকী সময় কাটাতে। সরাসরি বুঝিয়ে দেওয়া, সেই দলে তাঁকে জোর করে, নিয়মের কারণেই জায়গা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই কারণেই শ্বেতকায় ক্রিকেটারদের সঙ্গে আড্ডা দেবেন বা দল নিয়ে আলাপ আলোচনা করবেন, এমন ভাবনা নিছক বাড়াবাড়ি। কালোদের সেই অধিকার দেয়নি সাদারা। দলে নেওয়া হয়েছে ক্ষমাঘেন্না করে, তার বেশি আর কিছু যেন প্রত্যাশা করা না হয়।

‘গায়ের রঙটা ফিরে ফিরে আসে, জানো মাইকি’, অবাক হয়ে গিয়েছিলেন হোল্ডিং, টেলিফোন পেয়ে। ওধারে থিয়েরি অঁরি! স্কাই টেলিভিশনে সবে সম্প্রচার হয়েছে হোল্ডিং-এর ‘মনোলোগ’। তাঁর কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার যন্ত্রণাক্লিষ্ট দিনলিপি, হ্যাশট্যাগযুক্ত বিএলএম(ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার) আন্দোলনে শরিক হওয়ার কথা। তখন কথা বলার পর আবার অঁরির সঙ্গে কথা বলেছিলেন হোল্ডিং, এই বই লেখার সময়। ঘটনাটা শোনা যাক অঁরির মুখেই...
‘ইউরোপে এখন মানুষ আমাকে চেনে। ঔদ্ধত্য নয়, এমনিই জানাচ্ছি যে, আমাকে চিনতে পারে। কারণ, আমি ফুটবল খেলেছি সর্বোচ্চ স্তরে, জিতেছিও। আমি জয়ীদের দলে পড়ি, তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বীদের দলেও। তাই ইউরোপে তেমন সমস্যা হয় না। সমস্যা হয় আমেরিকা গেলেই। আমি ট্র্যাকসুট পরে থাকতে ভালবাসি। হুডিও (মাথাঢাকা জ্যাকেট)। টুপিও থাকে, কারণ, যেখানে যেভাবে বড় হয়েছি, ওগুলোই আমার পরিধেয়। নিউইয়র্ক সিটি বিমানবন্দরে নেমে বেরলাম। উবের বুক করলাম। চালকের সঙ্গে কথা হলো। দাঁড়িয়ে আছি। ট্যাক্সিটা এলো। দূর থেকে দেখল আমাকে, ব্যস, হুউউসসস্ করে বেরিয়ে গেল! আমি নিশ্চিত, ওটাই আমার ট্যাক্সি, কারণ, নম্বরটা তো আমার মোবাইলে এসেছে। কিছু করার নেই, নতুন করে অপেক্ষা। কেন চলে গেল সে? ওই যে আমার ট্র্যাকসুট, হুডি, লম্বা চেহারা আর গায়ের রঙ কালো। তাই বলছিলাম, যতই দূরে সরিয়ে রাখতে চাই না কেন, গায়ের রংটা ফিরে ফিরে আসে।’

টিভিতে মাইকেল হোল্ডিংয়ের বক্তৃতা শুনে থিয়েরি অঁরি নিজেই ফোন করেছিলেন তাঁকে

ফুটবলার হিসাবে ফ্রান্সের বিশ্বকাপজয়ী, ইউরোজয়ী দলের সদস্য, আর্সেনালকে ইংল্যান্ডের সেরা করে তোলার যুগে সেরা তারকা অঁরি। স্পেনে গিয়ে বার্সেলোনাতেও খেলেছিলেন মেসি-জাভিয়েস্তাদের সঙ্গে, জিতেছিলেন ইউরোপ-সেরার চ্যাম্পিয়নস লিগ খেতাব। আবার ওই স্পেনের কোচই একসময় বিপক্ষে থাকাকালীন তাঁকে দেখিয়ে বলেছিলেন ‘ব্ল্যাক শিট’। অঁরির যন্ত্রণা তাই শেষ হয় না। ‘বিরক্তি হয় কখন জানো? যখন কালো মানুষদের এখনও দেখা হয় শারীরিক এবং বাহ্যিক দিক দিয়ে, তাদের মানসিকতা দেখার প্রবণতা আজও মানুষের জন্মায়নি। এটা আরও বেশি করে বুঝেছি কোচের কাজ করতে গিয়ে। পুরোপুরি শ্বেতাঙ্গ-অধ্যুষিত সমাজ এখানে। আটের দশকের প্রজন্মের কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলাররা জেনেবুঝেই এ-কাজে আসেনি। জানত, ওদের কেউ ধর্তব্যের মধ্যেই আনবে না। নয়ের দশকে অবস্থা সামান্য পাল্টায়। কেউ কেউ চেষ্টা করেছিলেন। ২০০০ সালের পর থেকে অনেকেই আসছেন। যে কোনও সমস্যার মতোই এরও দুটি দিক ছিল। একটা দিক, দরজাটা আমাদের জন্য কোনও দিনও খুলবে না। অন্য দিকে, দেখিই না, কী করে দরজাটা খোলা যায়। আমরা সেই চেষ্টাটুকু করছি।’

চলবে...

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×