নেপিয়ারের খেলা দেখতে দেখতে মনে পড়ছে পানিয়াকে
উৎপল শুভ্র
৩০ মার্চ ২০২১
নেপিয়ারের খেলা দেখতে দেখতে মনটা দেখি নেপিয়ারেই চলে গেছে! পানিয়ার কথা তো মনে পড়ছেই। আরও অনেক টুকরো-টাকরা স্মৃতি মিলে তা একটা কোলাজ বানিয়ে ফেলছে।
টেলিভিশনে নেপিয়ারের ম্যাকলিন পার্কে টি-টোয়েন্টি দেখতে দেখতে হঠাৎ মনে প্রশ্ন জাগল, বাংলাদেশ দল এবার কোন হোটেলে উঠেছে? একটু খোঁজ নিলেই জানা যেত। ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ নিশ্চিত বলে ফোন কলটা করতে ইচ্ছা করল না। এর আগে বাংলাদেশ নেপিয়ারে যে চারটি ম্যাচ খেলেছে, চারবারই ঠিকানা ছিল সিনিক হোটেল টে পানিয়া। এবারও নিশ্চয়ই সেখানেই উঠেছে। নেপিয়ারে এটাই সবচেয়ে ভালো হোটেল। সিনিক গ্রুপের হোটেল, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। টে পানিয়া কেন যোগ হয়েছে, এবার সেটা বলি।
হোটেলের সামনেই সাগর। সাগরপারে পানিয়ার ভাস্কর্য। মাওরি উপকথার সেই জলকন্যা, এক মাওরি গোত্রনেতার টানে যে ছেড়ে এসেছিল জলের নিচের সব স্বজনকে। সকাল-সন্ধ্যা সেই স্বজনেরা আকুল হয়ে ফিরে যেতে বলত পানিয়াকে। একদিন তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে জলে নামল পানিয়া, আর ফেরা হলো না। জলের নিচে টেনে নিয়ে তাকে পাথর বানিয়ে রাখল ক্ষুব্ধ স্বজনেরা। হোটেলের নামটা এই পানিয়ার নামেই। টে পানিয়া।
নিছকই কল্পকথা। তা নেপিয়ার শহরের গল্পও তো কল্পকথার মতোই। ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে মাটিতে মিশে যাওয়া শহরের নতুন করে জেগে ওঠা কল্পকথা নয় তো কি! ছিমছাম সুন্দর নিরিবিলি শহরটাতে গেলে প্রথমেই আপনি একটু অবাক হয়ে যাবেন বাড়িগুলো সব প্রায় একই রকম দেখে। এর মূলেও ওই ভূমিকম্প। ১৯৩১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টা ৪৬ মিনিটে রিখটার স্কেলে ৭.৯ মাত্রার ভূমিকম্পে মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছিল নেপিয়ার শহরটা। ফিনিক্স পাখির মতো ছাইয়ের মধ্য থেকে আবার জেগে উঠেছে তা। নিজেদের মনমতো আবার তা গড়ে তোলার সুযোগও হয়েছে এতে।
যেন-তেনভাবে গড়ে তোলা হয়নি। শিল্পকলা আর স্থাপত্যে তখন আর্ট ডেকোর জয়জয়কার। পুনর্জন্মের সময় নেপিয়ারও এই রীতিতে নিজেকে সাজিয়ে তোলার সুযোগটা নিয়েছে। আর্ট ডেকো বিশ্বের আরও অনেক শহরকেই প্রভাবিত করেছে। তবে নেপিয়ারের মতো তা এত সর্বব্যাপী হয়নি কোথাও। সুযোগটা দিয়েছে ওই ভূমিকম্পই। ধ্বংস হয়ে গেছে যেখানে নতুন সৃষ্টির প্রেরণা। নেপিয়ার তাই নিজেকে দাবি করে ‘আর্ট ডেকো ক্যাপিটাল’ বলে। সেই দাবি সবাই মোটামুটি মেনেও নিয়েছে।
নেপিয়ারে আমি গিয়েছি দুইবার। ২০০৭ সালে প্রথম, ২০১০ সালে সর্বশেষ। দুই বছর আগের ট্যুরে বাংলাদেশ প্রথম ওয়ানডেটা খেলেছিল এই শহরেই। ক্রাইস্টচার্চ-নেপিয়ার রিটার্ন ফ্লাইটের টিকিট কেটে ফেলেছিলাম। টে পানিয়ায় রুম বুকিংও দেওয়া হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ট্যুরে রওনা হওয়ার আগে শরীরটা একটা বেগড়বাই করতে শুরু করায় শেষ মুহূর্তে নেপিয়ার ওয়ানডেটা বাদই দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। নেপিয়ারে তো আর সরাসরি যাওয়ার উপায় নেই। অকল্যান্ড বা ক্রাইস্টচার্চ নেমে সেখান থেকে ডোমেস্টিক ফ্লাইট ধরতে হবে। এত লম্বা ফ্লাইট ধরে নিউজিল্যান্ড পৌঁছেই নেপিয়ার যাওয়া-আসার বাড়তি দুটি ফ্লাইটের ধকল নেওয়ার সাহস হয়নি।
একটু আফসোসও যে হয়নি, তা নয়। সাগরপাড়ের যেকোনো শহরই আমার খুব পছন্দ। নেপিয়ারকেও তাই প্রথম দর্শনেই পছন্দ করে ফেলেছিলাম। আবার যেতে পারলে ভালোই লাগত। টে পানিয়া হোটেলটাতে আরেকবার থাকতে না পারার দুঃখটাও যোগ হয়েছিল এর সঙ্গে। যত না হোটেল, তার চেয়ে বেশি মিস করছিলাম পানিয়াকে। আহা, আর বুঝি তোমার সঙ্গে দেখা হবে না! নিস্প্রাণ ভাস্কর্যই তো, কিন্তু ওই মাওরি উপকথাটা শোনার পর থেকেই পানিয়ার সেই ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়ালে সেটিকে আমার জীবন্তই মনে হতো। আহা রে, প্রেমের কারণে বেচারিকে পাথর হয়ে যেতে হলো!
সাগরতলে পানিয়াকে যে পাথর বানিয়ে রাখা হয়েছে, সেটিও এমন সুন্দর কি না, তা তো আর জানি না। তবে মাটির পানিয়া খুব সুন্দর। তাঁকে রাখাও হয়েছে খুব যত্ন করে। চারপাশে ফুলের গাছ, সাগরপাড়ের বালিতে বিলীন হয়ে যাওয়ার আগে সবুজ ঘাস যেন গালিচা বিছিয়ে রেখেছে। পাশের রাস্তায় একটু পরপর হুস হুস করে চলে যাওয়া গাড়ির শব্দ ছাড়া চারপাশ যেন ‘মৌনতার সুতোয় বোনা একটি রঙিন চাদর’। সেই চাদরে ভাঁজে ভাঁজে হয়তো পানিয়ার নিঃশ্বাসেরই ছোঁয়া আর ভালোবাসার আদর।
নেপিয়ারের খেলা দেখতে দেখতে মনটা দেখি নেপিয়ারেই চলে গেছে! পানিয়ার কথা তো মনে পড়ছেই। আরও অনেক টুকরো-টাকরা স্মৃতি মিলে তা একটা কোলাজ বানিয়ে ফেলছে। মনে পড়ছে আল-শাহরিয়ার রোকনের কথা। নেপিয়ারে বাংলাদেশের খেলা থাকলেই অবধারিতভাবেই ছুটে আসেন রোকন। অনেক বছর ধরেই নেপিয়ার থেকে একটু দূরের এক শহরতলীতে বাস ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ানের। ১৯৯৭ সালে রোকনের সেই সেঞ্চুরি ছিল এই নিউজিল্যান্ডেই। নিয়তির কী খেলা, বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে তাঁকে অমর করে রাখা সেই সেঞ্চুরির দেশই কি না হয়ে গেল তাঁর নতুন ঠিকানা!
শুধু নেপিয়ারেই না, ওয়েলিংটনে বাংলাদেশের খেলাও পারতপক্ষে মিস করেন না রোকন। এবারও ওয়ানডে দেখতে গিয়েছিলেন। জাতীয় দলে খেলার সময় তাঁর বাঁধা রুমমেট হাবিবুল বাশারের সঙ্গে অনেক বছর পর দেখা হয়েছে। পুরনো সেই দিনের কথা বলতে বলতে দুজনের নির্ঘুম রাতের বর্ণনা দেওয়ার সময় ফোনেও হাবিবুলের কণ্ঠে আনন্দটা পরিষ্কার ফুটে বেরোচ্ছিল।
নেপিয়ারের কথা বললে মনে পড়ে তাউপো লেকও। যদিও তা নেপিয়ার থেকে বাসে দুই ঘণ্টা দূরত্বে। আমি অবশ্য তাউপো লেক হয়েই নেপিয়ারে গিয়েছিলাম। অকল্যান্ড থেকে বাসে নেপিয়ার যাওয়র পথে তাউপো লেকে ছিল যাত্রা বিরতি। বাস থেকে দেখেই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। নামার পর তো আরও। নির্মল জলরাশির কোনো কূলকিনারা দেখতে পাচ্ছিলাম না। পরে ট্রাভেল গাইড থেকে জেনেছি, নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে বড় জলাধার এই তাউপো লেক। যেটির জন্মও এক প্রাকৃতিক খামখেয়ালিতে। প্রায় ২৬,৫০০ বছর আগে মাউন্ট রুয়াপেহুর অগ্ন্যুৎপাত থেকে। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে প্রলয়ংকরী অগ্ন্যুৎপাতের একটি। এমনই প্রলয়ংকরী যে, চারপাশে ৮০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল ছাই আর লাভা। এই শহরে বেড়াতে আসা হাজার হাজার পর্যটককে মনে করিয়ে দেওয়া হয়, আগ্নেয়গিরিটি এখনো জীবন্ত। তখন পর্যন্ত আপডেট ছিল, সর্বশেষ ১৯৯৫ সালেও লাভা উদগীরণ করেছে এটি। গত ১৩/১৪ বছরে আর করেছে কি না জানি না। করেনি মনে হয়। করলে তো কোনো না কোনোভাবে খবর পেতামই। নিউজিল্যান্ডের দীর্ঘতম নদী ওয়াইকাটোর জন্মও এই তাউপো লেক থেকেই। যার আরেক নাম‘ট্রাউট ফিশিং ক্যাপিটাল অব দ্য ওয়ার্ল্ড। প্রতিবছর ২৫ এপ্রিল বা এর আগে-পরের কোনো দিনে ইন্টারন্যাশনাল ট্রাউট ফিশিং টুর্নামেন্টের আসরও বসে এখানে।
তাউপো লেক থেকে নেপিয়ারে ফিরি। ভূমিকম্পে শহরটির মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার কথা তো আগেই লিখেছি। তবে শুধু এটুকু লিখলে ভূমিকম্প যে নেপিয়ারকে কিছু দিয়েছেও, তা ভুলে যাওয়া হয়। ওই ভূমিকম্পেই ৪০ বর্গকিলোমিটার বড় হয়ে যায় নেপিয়ারের আয়তন! সমুদ্রের তলদেশ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দুই মিটার ওপরে উঠে গিয়ে আগের চেয়ে বড় করে দেয় নেপিয়ারকে। নেপিয়ার এয়ারপোর্টটাও তো ভূমিকম্পের কাছ থেকে উপহার পাওয়া ভূমিতে। এর আগে এখানে শুধু‘পোর্ট’ই ছিল,‘এয়ার’টা যোগ হয়েছে ভূমিকম্পের পর।
যে দুবার নেপিয়ারে গিয়েছি, টে পানিয়া হোটেলে ছিলাম একবারই। আরেকবার এই হোটেলে রুম না পেয়ে ছোট্ট একটা মোটেলে। সেই মোটেলের একটা মজার ঘটনা বলে লেখাটা শেষ করি। ছোট্ট মোটেলের ছোট্ট রিসেপশন। সামনে ডেস্কে অনেকগুলো কলম। তার একটা হাতে নিয়ে বললাম, ‘এটা কি আমি নিতে পারি?’
তরুণ রিসেপশনিস্ট হেসে বললেন, ‘অবশ্যই পারো। তবে নেওয়ার আগে একটু ভালো করে দেখে নেওয়া ভালো না?’
কলম আবার ভালো করে দেখার কী আছে! একটু অবাক হয়েই তাই কলমটা চোখের সামনে তুলে আনলাম। গায়ে কী সব যেন লেখা! যা পড়ার পর চোখ ছানাবড়া হয়ে যাওয়া বলতে যে একটা কথা আছে, তা-ই হয়ে গেল। কী লেখা, জানেন? ‘আই হ্যাভ স্টোলেন দিস্ পেন ফ্রম….মোটেল’। মানে ‘এই কলমটা আমি…মোটেল থেকে চুরি করেছি’। কী সুন্দর স্বীকারোক্তি!
মোটেলের নামটা ভুলে গেছি বলে জায়গাটা ফাঁকা রেখেছি। তবে ওই কলম নেওয়ার অর্থটা কী, তা বুঝতে তো আর সমস্যা হচ্ছে না। এই কলম নিয়ে ঘোরা মানে নিজেকে ‘চোর’ বলে ঘোষণা দেওয়া। রিসেপশনিস্ট হাসছেন, আমিও হাসছি। একটা কলম নিতে চেয়েছিলাম, আমি নিলাম দুইটা। এমন মজার একটা জিনিস, কলম চুরি ঠেকানোর বুদ্ধিও বলতে পারেন–এটা তো স্যুভেনির হিসাবে রেখে দেওয়ার মতো।
অনেক দিনই তা যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম। তারপর কখন যেন হারিয়ে গেছে। আমার মতোই জিনিসটাতে মজা পেয়ে কেউ চুরিই করেছে কি না, কে জানে! করে থাকলে একটাই আফসোস! চুরিটা কোত্থেকে হয়েছে, এই তথ্যটাতে তো ভুল থেকে গেল!