`বাংলা ভুয়া` `বাংলা ভুয়া`বলে সানি শর চিৎকার

উৎপল শুভ্র

১৩ জানুয়ারি ২০২২

`বাংলা ভুয়া` `বাংলা ভুয়া`বলে সানি শর চিৎকার

বাংলাদেশের সাংবাদিক পরিচয় পেয়েই `বাংলা ভুয়া` `বাংলা ভুয়া` চিৎকার করে বুঝিয়ে দিলেন বাংলাদেশকে তাঁর ভালোই মনে আছে। ইংল্যান্ডের যেমন `বার্মি আর্মি`, শ্রীলঙ্কার পার্সি অভয়শেখরা, পাকিস্তানের `বুড়ো চাচা` সুফি আবদুল জলিল, নিউজিল্যান্ডের তেমনি সানি শ। শুধু ক্রিকেট নয়, নিউজিল্যান্ডের অন্য খেলাতেও গ্যালারিতে অবধারিত তাঁর উপস্থিতি। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও।

সমুদ্রসৈকতে ওয়ার্ম আপ করতে করতে দক্ষিণ আফ্রিকান অলরাউন্ডার জ্যাক ক্যালিস নাকি এক সতীর্থকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'আচ্ছা, আমরা এখন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কত ফুট ওপরে?' আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারদের গড় বুদ্ধিমত্তা নিয়ে টীকাটিপ্পনী কাটার জন্য বহুল ব্যবহৃত উদাহরণ। বুদ্ধিমত্তা আর জ্ঞানগম্যির স্কেলে নিজেকে এর চেয়ে অনেক ওপরে বলেই এত দিন বিশ্বাস করে এসেছি। কিন্তু কাল যে নিজেকে 'জ্যাক ক্যালিস' বলেই মনে হলো।

কুইন্সটাউন থেকে ডানেডিন আসার বাস এমন চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এসেছে, উঠছি না নামছি বুঝতেই পারিনি। নামাটা তো আর সেভাবে খেয়াল করা যায় না, ওঠাটাই বেশি চোখে পড়ে। আমার তাই ধারণা ছিল, কুইন্সটাউন থেকে আমরা আরও ওপরেই উঠেছি। ডানেডিনে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা সেই ধারণার পক্ষে আরও জোরালো যুক্তি হয়ে এলো। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক ওপরের শহরগুলোই তো সচরাচর এমন ঠাণ্ডা হয়। ডানেডিন অনেক ওপরে বুঝতে পারছিলাম, কিন্তু কত ওপরে কোনো বইপত্রেই তা খুঁজে পাই না।

ছয় বছর ধরে ডানেডিনে আছেন, বাংলাদেশের এমন এক তরুণকে তাই জিজ্ঞেস করলাম, 'ডানেডিন সি লেভেল থেকে কত হাজার ফুট ওপরে?'

ওই তরুণ অবাক হয়ে বললেন, 'ওপরে হতে যাবে কেন? কুইন্সটাউন অনেক ওপরে, এখানে তো পাশেই সমুদ্র।'

'পাশেই সমুদ্র' কথাটা এমনভাবে বললেন যে, যেন ইউনিভার্সিটি ওভাল মাঠ থেকে উকিঝুঁকি মারলেই সমুদ্র দেখা যাবে। কাল লাঞ্চের সময় প্রেসবক্স থেকে মাঠের পুরো উল্টো দিকে যেতে যেতে সমুদ্র দেখা যায় কি না ভেবে তাই উকিঝুঁকি মারছি, হঠাৎ দেখি সামনে সানি শ। নিউজিল্যান্ডের 'ওয়ান ম্যান বার্মি আমি!'

২০০৪ সালের অক্টোবরে নিউজিল্যান্ডের বাংলাদেশ সফরের সময় তাঁকে দেখেছি। নিউজিল্যান্ডের বিশাল এক পতাকা নিয়ে প্রেসবক্সের সামনে দাঁড়িয়ে সারা দিন মাতিয়ে রাখতেন চারপাশ। কালও তাঁর হাতে ওই পতাকা, গলায় ঝোলানো একটা কিউই পাখি। জীবিত নয়, নিউজিল্যান্ডের জাতীয় পাখি এখন বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি, কেউ তা দেখতে পেলে বাকি জীবন গল্প করার রসদ পেয়ে যান। সানি শর বুকে ঝুলছে মনুষ্যনির্মিত একটা কিউই পাখি।

ক্রিকেট হোক বা রাগবি অথবা নেটবল...নিউজিল্যান্ডের খেলা মানেই মাঠে সানি শর সরব উপস্থিতি। ছবি: উৎপল শুভ্রবঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে গিয়ে শিখেছিলেন 'ভুয়া' কথাটা। তাঁকে দেখে দর্শকদের 'নিউজিল্যান্ড ভুয়া নিউজিল্যান্ড ভুয়া' চিৎকারের জবাব দিতেন 'বাংলাদেশ ভুয়া' 'বাংলাদেশ ভুয়া’ বলে। ইংল্যান্ডের যেমন 'বার্মি আর্মি', শ্রীলঙ্কার পার্সি অভয়শেখরা, পাকিস্তানের 'বুড়ো চাচা' সুফি আবদুল জলিল, নিউজিল্যান্ডের তেমনি সানি শ। সগর্বে জানালেন, এটি তাঁর ৯৮তম টেস্ট ম্যাচ।

ওয়েলিংটনে দ্বিতীয় টেস্টেও থাকবেন, কদিন পর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হ্যামিল্টনে শততম টেস্ট দেখা হয়ে যাবে তাঁর। শুধু ক্রিকেটই ধ্যানজ্ঞান নয়, সানি শ সত্যিকার ক্রীড়াপ্রেমী । নিউজিল্যান্ডের রাগবি, নেটবল সব খেলাতেই তাঁর সরব উপস্থিতি। ‘অল ব্ল্যাকস' নামে পরিচিত নিউজিল্যান্ডের রাগবি দলের এক শটি টেস্ট দেখে ফেলেছেন। ‘রাগবিতে এক শ টেস্ট হয়ে গেছে, ক্রিকেটেও হচ্ছে, নিউজিল্যান্ডে আর কারও এই রেকর্ড নেই'—বলার ভঙ্গি শুনে মনে হলো, জীবনে সানি শর আর কিছু চাওয়ার নেই।

বিভিন্ন খেলায় নিউজিল্যান্ড দলের পিছুপিছু ৪২টি ট্যুর করেছেন। নিজস্ব একটা ওয়েবসাইটও আছে। অন্য দুই দেশের খেলা দেখতেও প্রায়ই বেরিয়ে পড়েন। তা করে খেলার বাইরে অনেক মজার অভিজ্ঞতাও হয়েছে। হয়েছে একটা আক্ষেপের অভিজ্ঞতাও। ১৯৭১ সালে মেলবোর্নে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া টেস্ট দিয়ে সানি শর টেস্ট অভিষেক। বৃষ্টিতে টানা চার দিন খেলা না হওয়ার পর ফিরে আসেন দেশে। ইতিহাসের সাক্ষী হওয়াটা মিস হয়ে যায় তাতেই। পঞ্চম দিনে হতাশ দর্শকদের একটু আনন্দ দিতে সীমিত ওভারের যে ম্যাচটি হয়েছিল, পরে সেটিই প্রথম এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচের মর্যাদা পায়। কী দুঃখ! কী দুঃখ!

এত বাংলাদেশ-প্রেম, বাংলাদেশের কোন জিনিসটা সবচেয়ে ভালো লেগেছে? সানি শ দারুণ একটা হাসি দিলেন, 'গার্লস! বিউটিফুল গার্লস! বাংলাদেশে আমার একজন গার্লফ্রেন্ডও আছে।'

১৯৯৬ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়ে শুনলেন, সেঞ্চুরি করার পর মাঠে গিয়ে ব্যাটসম্যানের পকেটে টাকা ঢুকিয়ে দেওয়ার রীতির কথা। পোর্ট অব স্পেনে পর দিন ব্রায়ান লারা সেঞ্চুরি করতেই দৌড়ে মাঠে ঢুকে তাঁর পকেটে এক শ ডলারের একটা নোট ঢুকিয়ে দিয়ে এলেন। রাতে নিউজিল্যান্ড খেলোয়াড়দের সঙ্গে হোটেলের বারে বসে আছেন, লারা এসে তাঁকে একটা বিয়ার কিনে দিলেন।

স্টিভেন ফ্লেমিং বললেন, '১০০ ডলারে একটা! এটাই বিশ্বের সবচেয়ে দামি বিয়ার!' সঙ্গে কপট অভিমানও, আগের দিন ওয়ানডেতে প্রথম সেঞ্চুরি করেছেন ফ্লেমিং, 'কই, কাল তো তুমি আমার পকেটে ১০০ ডলার দিলে না!!

নিউজিল্যান্ড আবার কবে বাংলাদেশ সফরে যাবে জানতে চাইলেন। আবারও যেতে চান। নতুন স্টেডিয়ামটা (মিরপুর) কোথায়, আগের জায়গা থেকে কত দূরে বিস্তারিত খোঁজখবর নিলেন। এত বাংলাদেশ-প্রেম, বাংলাদেশের কোন জিনিসটা সবচেয়ে ভালো লেগেছে? নিউজিল্যান্ডের বড় একটা লিজিং কোম্পানির অ্যাকাউন্ট্যান্ট (চাকরিটা কীভাবে আছে কে জানে!) দারুণ একটা হাসি দিলেন, ‘গার্লস! বিউটিফুল গার্লস্! বাংলাদেশে আমার একজন গার্লফ্রেন্ডও আছে।

তাই নাকি! নাম কী? কীভাবে পরিচয়? জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলাম না। কিছু ব্যাপার গোপন থাকাই ভালো।

৪ জানুয়ারি, ২০০৮। ডানেডিন।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×