রোমাঞ্চের নাম জেটবোট রাইডিং

উৎপল শুভ্র

৭ জানুয়ারি ২০২২

রোমাঞ্চের নাম জেটবোট রাইডিং

কুইন্সটাউন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পসরা তো সাজিয়ে বসেছেই, সঙ্গে রোমাঞ্চের অনেক আয়োজনও। তারই একটা শটওভার নদীতে জেটবোট রাইডিং। জেটবোটটা কী? দেখতে স্পিডবোটের মতো। তবে এর আসল বৈশিষ্ট্য, মাত্র তিন সেন্টিমিটার পানিতেও এর চলবার বিস্ময়কর ক্ষমতা।

নিউজিল্যান্ডাররা শান্তিপ্রিয় জানতাম, একই সঙ্গে তাঁরা যে এমন রোমাঞ্চপ্রিয়ও, কুইন্সটাউন না এলে তা জানা হতো না। অ্যাডভেঞ্চার কাকে বলে এবং তা কত প্রকার, তা বোঝানোটাই যেন এই শহরের নিত্য দিনের চেষ্টা। সেই চেষ্টা থেকেই জন্ম বানজি জাম্পের। জেট বোটেরও। জেটবোটটা কী? দেখতে স্পিডবোটের মতো। তবে এর আসল বৈশিষ্ট্য, মাত্র তিন সেন্টিমিটার পানিতেও এর চলবার বিস্ময়কর ক্ষমতা। এটির উদ্ভাবক বিল হ্যামিল্টন নামে এক কৃষক। নদীতে পানি কম বলে নিজের জমিতে যাওয়ার সমস্যা দূর করতে তিনি উদ্ভাবন করে ফেলেন এই বিশেষ নৌযান। সেই জেটবোট রাইডিং অনেক দিনই কুইন্সটাউনে পর্যটকদের অবশ্য করণীয়ের এক নম্বরে।

কম পানিতে চলতে পারে—এমন একটা নৌযান ঠিক আছে। কিন্তু তাতে করে ঘুরে বেড়ানোয় এমন আর কী মজা? প্রশ্নটা অবধারিত। তবে সেই ঘুরে বেড়ানোটা কেমন, তা জানলে কেউ আর এই প্রশ্নটা তুলবে না। আমিই যেমন আর তুলছি না। কারণ কাল বিকেলে জেটবোট রাইডিংয়ের অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা বাকি জীবনের জন্য সঞ্চয় হয়ে গেছে আমার।

বাঙালির চিরন্তন ঘরকুনো স্বভাবের ধারক বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের ব্যাপারে একটা বড় অভিযোগ, ট্যুরে এসে খেলা আর প্র্যাকটিস ছাড়া হোটেল রুমেই বন্দি হয়ে থাকা। কোথাও যাওয়ার আগ্রহ নেই, কিছু দেখার আগ্রহ নেই। সেই ক্রিকেটাররা পর্যন্ত এবার কুইন্সটাউনে আসার আগেই ম্যানেজারকে বলে রেখেছিলেন, জেটবোট রাইডিংটা তাঁরা করবেনই। টেলিভিশনে ভারতীয় ক্রিকেটারদের যে করতে দেখেছেন।

কাল বিকেলে জেমি সিডন্স ছাড়া বাংলাদেশ দলের পুরো বছর তাই জেটবোট রাইডিং করতে গেল। সুযোগ পেয়ে ভিড়ে গেলাম বাংলাদেশের দুই সাংবাদিকও। আমি আর সাইদুজ্জামান। প্রতিটি বোটে ১৪ জনের বসার ব্যবস্থা। সামনে হিটার দিয়ে গরম করে রাখা রেলিং এবং সেটি শক্ত করে ধরে রাখার পরামর্শ। বোটে ওঠার আগেই পরিয়ে দেওয়া হয়েছে লাইফ জ্যাকেট। পরের পৌনে এক ঘণ্টার প্রায় প্রতিটি মুহূর্তেই মনে হলো, জিনিসটা আজ কাজে লাগবেই। তীরের বেগে ছুটে চলল জেটবোট, কোথাও কোথাও মাত্র আধহাত পানির ওপর দিয়েও। কখনো কখনো তো মনে হলো নুড়ি পাথরের ওপর দিয়েও। ড্রাইভার জানালেন, ঘণ্টায় ৮৫ কিলোমিটারের নিচে জেটবোট চালাতে তাঁর ভালো লাগে না।

শটওভার নদীর যে অংশটা এই জেটবোটের বিচরণক্ষেত্র, সেটিই মুগ্ধ হয়ে দেখার মতো। দু পাশে খাড়া উঠে গেছে পাহাড়, নিচে বিশাল বিশাল সব পাথর। কখনো মনে হলো, এই রে লেগেই গেল বুঝি। বেশির ভাগ সময় ড্রাইভার নিজেই তাতে লাগিয়ে দেওয়ার ভয় দেখালেন। শেষ মুহূর্তে কিভাবে সংঘর্ষটা এড়ালেন, তা বুঝতে পারিনি। আতঙ্কে যে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম!

একটু পরপরই মাথার ওপর আঙুল ঘুরিয়ে ইঙ্গিত দিলেন, এবার হবে বিখ্যাত সেই ‘৩৬০ ডিগ্রি স্পিন'। দু পাশে বাড়তি জায়গা প্রায় নেই-ই, তার মধ্যে ভোজবাজির মতো পুরো এক পাক ঘুরে গেল জেটবোট। আমাদের বোট রাইডের সময় বৃষ্টি নামল। তীরের ফলার মতো বৃষ্টি এসে চোখে বিঁধছে আর দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে চলেছে জেটবোট।

দু পাশে পাথরের মাঝখানে সরু জায়গায় এমন গতিতে জেটবোট চালান, দুর্ঘটনা ঘটে না? রসিক ড্রাইভার জবাব দিলেন, `আমি অনেক চেষ্টা করি। কিন্তু তার পরও অ্যাক্সিডেন্ট হয় না।'

ড্রাইভারের দিগ্বিদিক জ্ঞান যে ভালোই ছিল, অক্ষত অবস্থায় ফিরে এসে এই লেখা লিখতে পারাই তার প্রমাণ। এই যে দু পাশে পাথরের মাঝখানে সরু জায়গায় এমন গতিতে জেটবোট চালান, দুর্ঘটনা ঘটে না? রসিক ড্রাইভার জবাব দিলেন, `আমি অনেক চেষ্টা করি। কিন্তু তার পরও অ্যাক্সিডেন্ট হয় না।' পরে জানালেন, এই নদীতে ১৬০ ঘন্টা এভাবে চালানোর পর তবেই যাত্রীসহ চালানোর সুযোগ পান কোনো ড্রাইভার।

জেটবোট থেকে নেমে শটওভার জেটের অফিসে ঢুকতেই দেখি, টেলিভিশনে দেখানো হচ্ছে আমাদের জেটবোট অভিযান! ঘটনা কী? ঘটনা আর কিছুই না, আমরা জেটবোটে থাকতেই তৈরি হয়ে গেছে ভিডিও। ছবি-টবি সব প্রিন্ট করাও সারা। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল বলেই এত খাতির না, ‘খাতির'টা সবাইকেই করা হয়। টাকা কামানোর জন্যই তো এত আয়োজন। ৩টি ছবি আর কয়েক মিনিটের ভিডিও ধরে রাখা সিডির দাম ৩৯ নিউজিল্যান্ড ডলার! বাংলাদেশি টাকায় মাত্র ১৯৫০ টাকা!

৩০ ডিসেম্বর ২০০৭, কুইন্সটাউন।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×