অকল্যান্ডে অন্য রকম এক সন্ধ্যা
২ জানুয়ারি ২০২২
প্রবাসে তিনজন বাংলাদেশি থাকলে যেখানে চারটি দল হয়ে যায়, সেখানে সবার এক সংগঠনের নিচে জড়ো হওয়ার ঘটনা তো ব্যতিক্রমীই। সেই সংগঠন, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব নিউজিল্যান্ডের কল্যাণে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কালকের সন্ধ্যাটা রঙিন হয়ে থাকল। ২০০৭-২০০৮ মৌসুমে বাংলাদেশ দলের নিউজিল্যান্ড সফরের ডায়েরি।
নিউজিল্যান্ড নিয়ে লেখা একটি বই পড়তে গিয়ে খুব মজা পেলাম। দেশের পরিচিতি শুরু হয়েছে জনসংখ্যা দিয়ে। সেটি এ রকম—জনসংখ্যা : ৪১ লাখ মানুষ, ৩ কোটি ৯৩ লাখ ভেড়া। এই ৪১ লাখ মানুষের ১২ লাখেরই বাস 'তামাকি মাকাউরাউ'য়ে। কস্মিনকালেও এমন কোনো শহরের নাম শোনেননি? না শোনারই কথা। এটি অকল্যান্ডের মাওরি নাম। অর্থ—অনেকের কাঙ্ক্ষিত যে স্থান।
অনেকের কাঙ্ক্ষিত বলেই অকল্যান্ড দিন দিন ব্যস্ত থেকে আরও ব্যস্ততর হচ্ছে। শান্ত নির্জন হ্যামিল্টনে তিন দিন কাটিয়ে আসায় পরিবর্তনটা আরও বেশি চোখে লাগল। বড় বড় দালান, ঝলমলে ডিজাইনার শপ, রাস্তায় পর্যটকের ভিড়। হ্যামিল্টনের গা এলানো আয়েশি ভঙ্গিটা একদমই নেই। যেকোনো বড় শহরের মতোই সদাব্যস্ত ভাব। এসব দেখে-টেখে অনেকেই তাই অকল্যান্ডকে নিউজিল্যান্ডের রাজধানী বলে ভুল করে। একসময় তা-ই ছিল। সেটি অনেক অনেক দিন আগের কথা। তবে ওয়েলিংটন প্রশাসনিক রাজধানী হলে নিউজিল্যান্ডের বাণিজ্যিক রাজধানী এই অকল্যান্ডই।
নিউজিল্যান্ডের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশের বাস এই অকল্যান্ডে। যার মধ্যে হাজার দেড়েক বাংলাদেশিও আছেন। একসময় আরও বেশি ছিল, অনেকেই তাসমান সাগর পাড়ি দিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাওয়ায় পাঁচ-ছয় বছর ধরে সংখ্যাটা কমছেই। এখনো যাঁরা আছেন, তাঁদের বেশ একতাবদ্ধই মনে হলো। প্রবাসে তিনজন বাংলাদেশি থাকলে যেখানে চারটি দল হয়ে যায়, সেখানে সবার এক সংগঠনের নিচে জড়ো হওয়ার ঘটনা তো ব্যতিক্রমীই। সেই সংগঠন, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব নিউজিল্যান্ডের কল্যাণে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কালকের সন্ধ্যাটা রঙিন হয়ে থাকল।
যেকোনো সফরে বাংলাদেশ দলকে নিয়ে প্রবাসীদের এমন আয়োজনকে নিয়মিতই বলতে পারেন। বলতে গেলে বাংলাদেশ দলের যেসব ভেন্যুতে খেলা থাকে, সব শহরেই। বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ডাল-ভাত খাওয়ানোর একটা প্রতিযোগিতাও শুরু হয়ে যায় প্রবাসীদের মধ্যে। এবারের টিম ম্যানেজমেন্ট এ ব্যাপারে একটু রাশ টেনেছে বলে এবার তা খুব একটা হচ্ছে না। তবে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের আমন্ত্রণে তো আর 'না' করা যায় না। একই সঙ্গে বিজয় দিবস উদযাপন ও বাংলাদেশ দলকে দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটা এমন চমৎকার হলো যে, টিম ম্যানেজমেন্টেরও হয়তো মনে হয়েছে, এতে 'না' বললে ভুলই হতো।
ব্যতিক্রমী বলতে হচ্ছে এটিকেও। কারণ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই জানি, এ ধরনের অনুষ্ঠান সাধারণত খুব বোরিং হয়। আয়োজকদের হর্তাকর্তারা এমন লম্বা বক্তৃতা শুরু করেন যে, ক্রিকেটাররা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হোটেলে ফিরতে উসখুস শুরু করেন। এখানে এমন হলো না। বরং আয়োজক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি তরুণ কান্তি চৌধুরীই দিলেন সংক্ষিপ্ততম বক্তৃতাটা। ক্রিকেটারদের জন্য অনুষ্ঠান, ক্রিকেটাররাই হয়ে থাকলেন এর মধ্যমণি। ম্যানেজার আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি, অধিনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুল, কোচ জেমি সিডন্স, নির্বাচক নাঈমুর রহমান প্রাণবন্ত বক্তৃতা দিলেন।
কুইজ, গেম—এসবের আয়োজনেও ছিল অভিনবত্ব। কুইজের প্রশ্নগুলোও ছিল খুব মজার—গত বিশ্বকাপে বাংলাদেশ-দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচে আম্পায়ার ছিলেন কারা? বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে বেশি রান করেছিলেন কে? সবচেয়ে বেশি উইকেট ছিল কার?
আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি কথা বলেন ভালো। তাঁর বক্তৃতায় ক্রিকেট যে বাংলাদেশের জন্য শুধুই একটা খেলা নয়, এই অংশটা মনে গেঁথে থাকার মতো। ববি বললেন, ক্রিকেট বাংলাদেশকে তিনটি জিনিস দিয়েছে। এক. বাংলাদেশকে একটা নতুন আত্মপরিচয়। দুই. পুরো দেশকে এক সুতোয় গাঁথার একটা উপলক্ষ। তিন. একটা প্রজন্মকে অসম্ভবকে সম্ভব মনে করার সাহস। চমৎকার বিশ্লেষণ।
ক্রিকেটাররা প্রবাসীদের কাছে এমনই ‘হিরো’ যে, তাঁরা যা করেন, যা বলেন, তাতেই তুমুল করতালি। তবে সবচেয়ে বেশি করতালিতে স্নাত হলেন মেহরাব হোসেন জুনিয়র। নিজেকে 'বাথরুম সিঙ্গার' হিসেবে পরিচয় দিলেও পুরো পেশাদার শিল্পীর মতো গিটার বাজিয়ে দুটি গান শোনালেন এই বাঁহাতি অলরাউন্ডার। রোনাল্ড কিটিংয়ের 'ইউ সেইড দ্য বেস্ট হোয়েন ইউ সে নাথিং' এমন চমৎকার গাইলেন যে, জেমি সিডন্স পর্যন্ত হাত-পা দিয়ে তাল দিতে দিতে তাঁর সঙ্গে সুর মেলালেন। ইংরেজি গান তো আর সব বাংলাদেশি শোনেন না, বাকি শ্রোতাদের সুর মেলানোর ঘটনা তাই খুব একটা ঘটল না। তবে মেহরাব যখন ‘তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা’ টান দিলেন, উত্তাল হয়ে উঠল পুরো হলরুম। সিডন্সকে ততক্ষণে এমনই সুরে পেয়েছে যে, তাঁকে পর্যন্ত ঠোঁট নাড়াতে দেখলাম! কী গাইলেন, তিনিই জানেন!
ক্রিকেট দল নিয়ে মাঝে-মধ্যেই আদিখ্যেতায় চলে যাওয়া বাংলাদেশিদের আবেগের কথা জানেন বলেই অনুষ্ঠানের শুরুর দিকেই তাঁর বক্তৃতায় সিডন্স পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, 'এই সফরে জিতলে ভালো। তবে কেউ যেন কোনো প্রত্যাশা না করেন।'
তাঁর কথা কে শোনে! অনুষ্ঠানস্থল থেকে বেরিয়ে আরেক জায়গায় খাওয়ার আয়োজনে যাওয়ার সময় ক্রিকেটারদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অনেককেই বলতে শুনলাম— ২৬ তারিখের ম্যাচটা কিন্তু জেতা চাই।' হায় রে বাঙালি!
২৪ ডিসেম্বর, অকল্যান্ড