ক্রিসমাসে শুনশান `সিটি অব সেইলস্`

উৎপল শুভ্র

৩ জানুয়ারি ২০২২

ক্রিসমাসে শুনশান `সিটি অব সেইলস্`

পৃথিবীতে মাথাপিছু বোটের সংখ্যার দিক থেকে অকল্যান্ডই এক নম্বরে। দুই বছর আগের এক হিসেবে দেখলাম, একেবারে নিয়ম মেনে তৈরি করা সেইলিং বোটের সংখ্যাই এখানে ১ লাখ ৩৫ হাজার। একটু অন্যরকম নৌযান মিলিয়ে সংখ্যাটা দুই লাখের মতো। ৩ লাখ ৭০ হাজার লোকের শহরে দুই লাখ বোট, এবার বুঝুন! সেইলিং বোটটা যে এই শহরের বাসিন্দাদের ‘নিত্যপ্রয়োজনীয়’ দ্রব্যাদির তালিকাতেই পড়ে, বেশ কটি বাড়ির গ্যারেজ দেখেই বুঝতে পেরেছি। কিভাবে?

অকল্যান্ডে আজ হরতাল নাকি? রাস্তাঘাট এমন শুনশান কেন? দাবি-টাবি নিয়ে আন্দোলনের ব্যাপারটাই বলতে গেলে নিউজিল্যান্ডারদের কাছে অজানা, আর দাবি আদায়ের জন্য নিজেদের কাজ ফেলে ঘরে বসে থাকার আত্মঘাতী চিন্তাটা তো তাদের কাছে একদমই অচিন্তনীয়। এটি জানা থাকার পরও সকালে ঘুম থেকে উঠে ক্রাউন প্লাজা হোটেলের ১৮ তলার রুমের পর্দা সরানোর পর হরতালের কথাটাই মনে হলো সবার আগে।

কালই হোটেলের সামনের অ্যালবার্ট স্ট্রিট ও একটু দূরের যে কুইন স্ট্রিট মানুষে গিজগিজ করতে দেখেছি, তাতে জনমনিষ্যির চিহ্নও নেই। গাড়িঘোড়ারও (গাড়ির সঙ্গে কিভাবে যেন ঘোড়াটাও চলে আসে, ব্যস্ত শহরের রাজপথে ঘোড়া আসবে কোত্থেকে?) নয়। দোকানপাটও সব বন্ধ। অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভাঙার পর কিছুক্ষণ যে ঘোরঘোর ভাবটা থাকে, সেটি কেটে যাওয়ার পর মনে পড়ল, আজ তো ক্রিসমাস।

ছয় বছর আগে নিউজিল্যান্ডে আরেকটি ক্রিসমাস কাটানোর অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেবার ছিলাম ওয়েলিংটনে। সেদিনও ওয়েলিংটন নিশ্চয়ই এমন শুনশানই ছিল। কিন্তু ছয় বছর তো কম সময় নয়, ভুলেই গিয়েছিলাম ক্রিসমাসের দিনটিতে এই দেশের শহরগুলো এমনই মৃতপুরী হয়ে যায়। আমাদের দেশে ঈদ বা পুজার মতো ধর্মীয় উৎসবগুলোতে রাস্তাঘাট আরও বেশি মুখরিত হয়ে ওঠে। ক্রিসমাস দেখছি ব্যতিক্রম। এটি একেবারেই ব্যক্তিগতভাবে উদযাপনের ব্যাপার। পরিবারের সবার সঙ্গে মিলেমিশে কাটানোর দিন। রাস্তাঘাটে হইচই, উৎসব-আয়োজন যা কিছু হয়, তার সবই ক্রিসমাসের আবাহনে। একটু পর হোটেলের রিসেপশনে নেমে শুনশান শহরের কথা বলতে তরুণী রিসেপশনিষ্ট একটু বিস্মিত হয়েই বলল, 'ক্রিসমাসে তো এমনই হয়। তা ছাড়া প্রচুর লোক ছুটি কাটাতে চলে গেছে। ক্রিসমাসের দিন থেকেই এ দেশে লম্বা ছুটি শুরু হয়।'

এটা যে অকল্যান্ডের আসল চেহারা নয়, আগের দিনই বুঝেছি। সিলভিয়া নামের ওই তরুণীর তা জানার কথা নয়। সেটি বুঝিয়ে দেওয়া দায়িত্ব বলে মনে করে ও তাই বলল, 'তুমি কি জানো, অকল্যান্ডে অনেক মানুষ! এখানে নিউজিল্যান্ডের জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশের বাস! শুধু অকল্যান্ড শহরের লোকসংখ্যাই ৩ লাখ ৭০ হাজার!' আমি হেসে বললাম, 'কার কাছে কী বলছ! আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। ঢাকায় আমার পাড়াতেই তো এর চেয়ে বেশি লোক থাকে। সিলভিয়া তাঁর নীল চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকল। নিশ্চয়ই ভেবেছে, আমি রসিকতা করছি।

অকল্যান্ড শহরের প্রাণকেন্দ্রে স্কাই টাওয়ার, যেটিকে ঘিরে স্কাই সিটি কমপ্লেক্সক্রাউন প্লাজা হোটেলের পাশেই স্কাই সিটি কমপ্লেক্স। ক্যাসিনো, রেস্টুরেন্ট, ক্যাফে, বার, হোটেল...কী নেই সেখানে। সবচেয়ে দর্শনীয় হয়ে আছে স্কাই টাওয়ার। মিনারের মতো উঠে যাওয়া ৩২৮ মিটার উঁচু এই স্কাই টাওয়ার এই গোলার্ধের সবচেয়ে উচ্চতম মনুষ্য-নির্মাণ। লিফটে করে সেটির একদম উপরে উঠে যাওয়া যায়, সেখানে চার পাশে কাঁচে ঘেরা 'অবজার্ভেশন ডেক' থেকে চার দিকে অকল্যান্ডের প্রায় ৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত দৃশ্যমান থাকে। তবে সেটির বিনিময়মূল্যটা এমনই বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে যে, ট্যুরিস্ট গাইডে পড়া ‘এটি অকল্যান্ডে অবশ্য দ্রষ্টব্য' পরামর্শটা ভুলে যেতে একদমই সমস্যা হয়নি।

স্কাই সিটিতে ঢুকে কিছু লোকজনের দেখা মিলল। বেশির ভাগেরই নাক চ্যাপ্টা। অকল্যান্ডে আসার পর থেকেই রাস্তাঘাটে প্রচুর মঙ্গোলিয়ান মুখ দেখছিলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম, বোধ হয় চীন-জাপান কোরিয়া থেকে আসা পর্যটক। এক প্রবাসী বাংলাদেশি ভুলটা ভাঙিয়ে দিয়েছেন। এদের বেশির ভাগই নাকি অকল্যান্ডের স্থায়ী বাসিন্দা এবং আশি শতাংশই মহান চীন থেকে আগত। স্কাই সিটির নিচে রেষ্টুরেন্টে তাঁদেরই চার জনের একটি দলকে পর দিন সেইলিংয়ে যাওয়া নিয়ে মহা উত্তেজিত আলোচনায় মেতে থাকতে দেখলাম।

এটা অবশ্য বলার মতো কিছু নয়। অকল্যান্ডে এসে সেইলিং নিয়ে আলোচনা না করলেই বরং সেটিকে বিস্ময় মানা হয়। এই শহরের আরেক নামই যে 'সিটি অব সেইলস্”। সেটি হয়েছে দারুণ দুটি পোতাশ্রয়ের কল্যাণে। অকল্যান্ডের প্রতীক হয়ে আছে ওই দুটি পোতাশ্রয় (এর চেয়ে হারবার কথাটাই কি বেশি বোধগম্য?)। ওয়াইতেমাতা ও মানুকাও পোতাশ্রয়ের মাঝখানে স্যান্ডউইচের মতো সরু একটা ভূমিখন্ডের নামই অকল্যান্ড।

অকল্যান্ড হারবারে বোট আর বোট...সিডনি হারবার ব্রিজের মতো বহুবিজ্ঞাপিত না হলেও অকল্যান্ড হারবার ব্রিজটাও কম সুন্দর নয়। ২০০১ সালে সেটিতে দাঁড়িয়ে বিস্ময়কর এক দৃশ্য দেখেছিলাম। যতদূর চোখ যায়, শুধু বোট আর বোট। পৃথিবীতে মাথাপিছু বোটের সংখ্যার দিক থেকে অকল্যান্ডই এক নম্বরে। দুই বছর আগের এক হিসেবে দেখলাম, একেবারে নিয়ম মেনে তৈরি করা সেইলিং বোটের সংখ্যাই এখানে ১ লাখ ৩৫ হাজার। একটু অন্যরকম নৌযান মিলিয়ে সংখ্যাটা দুই লাখের মতো। ৩ লাখ ৭০ হাজার লোকের শহরে দুই লাখ বোট, এবার বুঝুন! সংখ্যাটা নিশ্চয়ই গত দু বছরে আরও বেড়েছে। সেইলিং বোটটা যে এই শহরের বাসিন্দাদের ‘নিত্যপ্রয়োজনীয়’ দ্রব্যাদির তালিকাতেই পড়ে, বেশ কটি বাড়ির গ্যারেজ দেখেই বুঝতে পেরেছি। কিভাবে?

স্থলযান ও জলযানের সহাবস্থানে। গাড়ির পাশেই বোট!

২৫ ডিসেম্বর, ২০০৭। অকল্যান্ড।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×