ওয়াইকাটো একটি নদীর নাম

উৎপল শুভ্র

১ জানুয়ারি ২০২২

ওয়াইকাটো একটি নদীর নাম

অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্যের দেশ নিউজিল্যান্ড। সেই দেশের এক শহর থেকে আরেক শহরে ঘুরে বেড়ানোর রোমাঞ্চ ধরা আছে এই ধারাবাহিকে। ২০০৭ সালে যে ভ্রমণের সূচনা হয়েছিল ছোট্ট শহর হ্যামিল্টন দিয়ে। যে শহরের অবিচ্ছেদ্য অংশ ওয়াইকাটো নদী আর মাওরি জনগোষ্ঠী, নিউজিল্যান্ডের আদিবাসী।

নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে বড় শহর অকল্যান্ড থেকে গাড়িতে দেড় ঘণ্টার দূরত্বে হ্যামিল্টন। ছবির মতো সাজানো-গোছানো ছোট্ট এক শহর, যেখানে হ্যামিল্টন নামটা দেখবেন, তার চেয়ে বেশি দেখবেন 'ওয়াইকাটো' নামটি। স্থানীয় পত্রিকার নাম ওয়াইকাটো টাইমস, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বিয়ারের নাম ওয়াইকাটো ড্রট, স্যুভেনিরের দোকানে নানা কিছুতে উৎকীর্ণ এই নাম, এমনকি এই শহরের জাদুঘরটির নাম পর্যন্ত ওয়াইকাটো মিউজিয়াম অব আর্ট অ্যান্ড হিস্ট্রি। এই ওয়াইকাটো একটি নদীর নাম।

ছোটবেলায় আমরা সবাই 'ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত' মুখস্থ করেছি, কিন্তু ঢাকাবাসীর জীবনে বুড়িগঙ্গার বড় কোনো ভূমিকা নেই। একবারও বুড়িগঙ্গা দেখেননি, ঢাকায় এখন অনেক লোকেরও দেখা মিলবে। হ্যামিল্টন ও ওয়াইকাটোর ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। দেখে-শুনে-পড়ে মনে হলো, ৪২০ কিলোমিটার বয়ে যাওয়া নিউজিল্যান্ডের দীর্ঘতম এই নদীর সঙ্গে দেখা না করাটা এখানে 'পাপ'-এর পর্যায়ে পড়ে। সেই পাপ করাটা ঠিক হবে না বলেই ওয়াইকাটো নদীর তীর ঘেঁষে অসাধারণ 'ওয়াকওয়ে'টা দিয়ে অনেকক্ষণ হাঁটলাম। পাশে রেলিং দেওয়া ইট বিছানো রাস্তা, দুপাশে ফুটে আছে রংবেরঙের ফুল। হাঁটতে হাঁটতে বুড়িগঙ্গার কথা ভেবে বেশ কটি দীর্ঘশ্বাসও ফেললাম। ওয়াইকাটো নদীর কথা যত জায়গায় পড়লাম, একটা কথা কমন—মাইটি ওয়াইকাটো। নদীর সঙ্গে ব্যবহৃত 'মাইটি' শব্দের বাংলাটা কী হবে? প্রমত্তা? বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আট-আটটি বাঁধের ধাক্কা সামলেও ওয়াইকাটোর যে চেহারা দেখলাম, তাতে প্রমত্তা শব্দটা দিব্যি মানিয়ে যায় এর সঙ্গে।ওয়াইকাটো নদী, ছবির মতোই সুন্দর। ছবি: ফেয়ারফ্যাক্স নিউজিল্যান্ড

ওয়াইকাটো এখানে শুধুই একটি নদীর নাম নয়, ইতিহাস-ঐতিহ্য সভ্যতা সবকিছু এতে মিলেমিশে একাকার। হ্যামিল্টনকে কেন্দ্রে রেখে আশপাশে যে বিস্তৃত এলাকা, সেটির নাম পর্যন্ত ওয়াইকাটো অঞ্চল। নিউজিল্যান্ডে মানববসতির ইতিহাসও জড়িয়ে এই ওয়াইকাটোর সঙ্গে। আজ থেকে সাড়ে পাঁচ শ-ছয় শ বছর আগে হাজার হাজার কিলোমিটারের অভিযান শেষে 'তাইনুই ক্যানো' নামে পরিচিত একটি নৌকা ভিড়েছিল এই নদীর তীরে। সেই নৌকায় ছিল সুদূর হাওয়াইকি থেকে আসা মাওরিদের একটি দল। এই মাওরিরাই নিউজিল্যান্ডের আদিবাসী। হ্যামিল্টন থেকে শখানেক কিলোমিটার দূরে কহিয়ায় ভিড়েছিল সেই নৌকা, বসতি স্থাপনের জন্য উপযুক্ত জায়গা খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারটি নিশ্চিত হয়ে নৌকাটিকে নদী থেকে তুলে পুঁতে রাখা হয়েছিল মাটির নিচে। দু'পাশে দুটি পাথর দিয়ে চিহ্নিত করে রাখা সেই 'তাইনুই ক্যানো'র সমাধিস্থল এখন মাওরিদের তীর্থস্থান।

নদীর জল ছিল, ছিল পাশে উর্বর ভূমি। এই ওয়াইকাটো নদীর তীর ঘেঁষেই ক্রমশ বিস্তৃত হতে থাকে মাওরিদের বসতি। নদীর প্রায় প্রতিটি বাঁকেই গড়ে ওঠে পা (মাওরি গ্রাম), প্রতিটি পাতেই একজন করে গোত্রনেতা। মূলত কুমড়া (মিষ্টি আলু) ফলিয়েই ক্ষুন্নিবৃত্তি হতো তাদের। একসময় ইউরোপিয়ানরাও ঘুরতে ঘুরতে চলে আসে এদিকে। ১৮৩০-এর দশকে ইউরোপিয়ান মিশনারিদের কাছ থেকে চাষবাসের উন্নততর কৌশলও শিখে নেয় মাওরিরা। শুরু হয় অকল্যান্ডে বসতি গাড়া ইউরোপিয়ানদের সঙ্গে বাণিজ্যও। পরের ইতিহাস বিশ্বের অন্য আরও অনেক দেশের মতোই। ১৮৫০-এর দশকে শুরু হয়ে যায় দুই সংস্কৃতির লড়াই, যেটির মূলে ছিল বসতি স্থাপনের জন্য মাওরিদের কাছ থেকে জমি কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা। জমির জন্য লড়াই মানব ইতিহাসের প্রাচীনতম লড়াই। সেই লড়াই লড়তেই ১৮৬০-এর দশকে মাওরিরা সব একতাবদ্ধ হয়ে একজন রাজা নির্বাচিত করে। ১৮৬৩ সালে যুদ্ধই বেঁধে যায় দু'দলের। সেই যুদ্ধের নামও 'ওয়াইকাটো যুদ্ধ'। একদিকে পাঁচ হাজার মাওরি, অন্যদিকে ২০ হাজার ইউরোপিয়ান ও তাদের সহযোগীরা। এক পক্ষের সম্বল হাতে বানানো অস্ত্র, আরেক পক্ষের হাতে বন্দুক-কামান-গানবোট। 'পাকেহা'দের (ইউরোপিয়ানদের এই নামেই ডাকত মাওরিরা, যার অর্থ 'সাদা মানুষ') সঙ্গে বছরখানেক চলে মাওরিদের এই অসম যুদ্ধ। শেষ পর্যন্ত টিকতে না পেরে মাওরিরা পশ্চাদপসরণ করে আরও দক্ষিণে সরে যায়। কথিত আছে, সেখানে গিয়ে মাওরি রাজা তহহিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বড় একটা মানচিত্রের ওপর মাথার টুপি রেখে ঘোষণা করেন, টুপিতে আবৃত জায়গাটা হবে তাঁর রাজত্বাধীন। অনেক বছর তা-ই হয়ে ছিল, পাকেহাদের প্রবেশাধিকার পর্যন্ত ছিল না সেখানে। সেই জায়গাটির নাম হয়ে গেছে কিং কান্ট্রি, এখনো সেখানে মাওরিদেরই সংখ্যাধিক্য।মাওরি জনগোষ্ঠী আদি ঠিকানা ছিল এই হ্যামিল্টনই। ছবি: এএপি

আগের রাতে বইপত্র পড়ে, ইন্টারনেট ঘেঁটে মাওরিদের ইতিহাস জানার পর কাল সকালে ঘুরে এলাম ওয়াইকাটো জাদুঘর, যেখানে ধরা রয়েছে মাওরি সংস্কৃতির সব ইতিহাস। কাল দুপুরে হোটেল থেকে স্টেডিয়ামে এলাম যে ট্যাক্সিতে, সেটির চালকের চেহারা আর নাম (ম্যাকন) দেখে সন্দেহ হলো। জিজ্ঞেস করায় পেলাম গর্বিত উত্তর-হ্যাঁ, আমি মাওরি। নিউজিল্যান্ডের জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ এখনো মাওরি, ইংরেজির সঙ্গে মাওরিও সরকারি ভাষা। আমেরিকা বা তার আদিবাসীদের মতো মাওরিদের অস্তিত্বের লড়াই লড়তে হচ্ছে না। মূল স্রোতে গিয়ে রা মাথা উঁচু করেই বেঁচে আছে। আত্মপরিচয় দিতে ম্যাকনের গর্ব বোধ করাটাই স্বাভাবিক।

মাওরি সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতেই বেশির ভাগ পর্যটক হ্যামিল্টনে আসে। ইদানীং অবশ্য যোগ হয়েছে আরেকটি আকর্ষণও। পিটার জ্যাকসন তাঁর লর্ডস অব দ্য রিং ট্রিলজি কাটিং করার জন্য হবিটন নামে যে অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্যের জায়গাটা বেছে নিয়েছিলেন, সেটি হ্যামিল্টন থেকে গাড়িতে মাত্র আধঘণ্টা দূরত্বে। লর্ডস অব দ্য রিংসের সেটের যা কিছু অবশিষ্ট আছে, তা দেখাতে গাইডেড ট্যুরেরও আয়োজন আছে সেখানে।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×