কুইন্সটাউন: রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষের স্বর্গ

উৎপল শুভ্র

৫ জানুয়ারি ২০২২

কুইন্সটাউন: রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষের স্বর্গ

নিউজিল্যান্ড দেশটাই এমন ছবির মতো যে সবচেয়ে সুন্দর শহর বেছে নিতে কষ্ট হতেই পারে। আমার অবশ্য একটুও তা হয় না। কুইন্সটাউনের কোনো তুলনাই যে খুঁজে পাই না। শুধু নিউজিল্যান্ড কেন, বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর শহর হিসেবেও দাবি তুলতে পারে কুইন্সটাউন। এমনিতেই তো আর পর্যটকরা ভিড় জমায় না এখানে।

এয়ারপোর্ট ছোঁয়াকে যদি শহর ছোঁয়া ধরা হয়, তাহলে এক দিনে নিউজিল্যান্ডের চারটি শহর "ঘোরা" হয়ে গেল। সকাল সাতটায় নেপিয়ার থেকে রওনা হয়ে দুপুর সাড়ে ১২টায় কুইন্সটাউনে নামার পথে হয়ে এলাম ওয়েলিংটন ও ক্রাইস্টচার্চ। ৫৫ মিনিট, ৪৫ মিনিট ও এক ঘণ্টা ৫ মিনিটের তিনটি ফ্লাইট। মানে বিমানে ওঠো আর নামো!

পরের গন্তব্য কুইন্সটাউন জেনে নেপিয়ারের লোকজন পর্যন্ত উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছে, 'আহ্, কুইন্সটাউন! কী যে সুন্দর!' অকল্যান্ড থেকে বাসে নেপিয়ারে আসতে আসতে নর্থ আইল্যান্ডও কম সুন্দর মনে হয়নি। অথচ নিউজিল্যান্ডে আসার পর থেকেই শুনছি, 'নর্থ আইল্যান্ড আর কী! সাউথ অনেক বেশি সুন্দর।' নিউজিল্যান্ডের সাউথ আইল্যান্ডে এই প্রথম। ২০০১ সালে আগের সফরে বাংলাদেশের খেলা ছিল শুধু অকল্যান্ড, হ্যামিল্টন ও ওয়েলিংটনে। এই তিন শহর দেখেই মুগ্ধতা প্রকাশ করার পর তখনো শুনেছি, নিউজিল্যান্ডের দক্ষিণেই নাকি প্রকৃতি সব ঐশ্বর্য ঢেলে দিয়ে দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি দিয়েছে কুইন্সটাউনে।

টিভির পর্দায় কুইন্সটাউন দেখেই তা কিছুটা বুঝতে পেরেছিলাম। মূলত মাঠটাই দেখেছি। মাঠই, স্টেডিয়াম নয় । এয়ারপোর্টের ঠিক পাশে। একটু দূরেই খাড়া উঠে গেছে পাহাড়, তাঁর নিচে যেন সবুজ গালিচা বিছানো। নামটাও খুব মজার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ভেন্যু-অথচ নাম কুইন্সটাউন ইভেন্ট সেন্টার! স্থায়ী গ্যালারি-ট্যালারি কিচ্ছু নেই। সাংবাদিকদের বসার ব্যবস্থা মাঠের পাশে তাঁবুতে। ড্রেসিংরুমও নাকি তা-ই!

কুইন্সটাউনে আসার পথে চমকে দেওয়া অভিজ্ঞতার কথাটা আগে বলি। নেপিয়ার থেকে বিমানে উঠছি । চেকিং-ফেকিং কিচ্ছু নেই। এমনকি লাগেজ পর্যন্ত স্ক্যান করা হলো না! ওয়েলিংটন ও ক্রাইস্টচার্চ বিমানবন্দরেও একই অভিজ্ঞতা। ক্রাইস্টচার্চে তো এয়ারপোর্টের বাইরে থেকেও ঘুরে এলাম। লোকজন ঢুকছে-বেরোচ্ছে। নিরাপত্তাব্যবস্থা বলে কিছু চোখেই পড়ল না। দেখে মহাবিস্মিত, এটা কি হানাহানিময় এই অস্থির সময়ের পৃথিবীরই কোনো দেশ! নিউজিল্যান্ডের পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠাজুড়ে বেনজির ভুট্টোর হত্যাকাণ্ডের ছবি আর খবর অবশ্য খুব তাড়াতাড়িই বাস্তবতাটা মনে করিয়ে দিল। রাওয়ালপিন্ডির রক্তাক্ত রাজপথের ছবি দেখতে দেখতে মনে আক্ষেপ জাগল—আহা! পুরো পৃথিবীটাই যদি নিউজিল্যান্ডের মতো হতো!

পর্যটকদের জন্য কুইন্সটাউন কত কী আয়োজন সাজিয়ে যে বসে আছে! ছোট্ট শহর, জনসংখ্যা মাত্র সাড়ে আট হাজার। পর্যটকদের সংখ্যা প্রায়ই তার চেয়ে বেশি হয়ে যায়।

এই যে নিউজিল্যান্ডের যে শহরেই যাই, সেখানেই পর্যটকদের মিছিল দেখি, সেটির কারণ তো শুধুই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়। সন্ত্রাসমুক্ত দেশ হিসেবে নিউজিল্যান্ডের পরিচিতিও। নেপিয়ারের প্রবাসী বাংলাদেশির মুখে ঝুটঝামেলাহীন নিউজিল্যান্ডারদের শান্তিপ্রিয়তার কথা শুনছিলাম। এই যুগে এসেও নিউজিল্যান্ডের পুলিশের কাছে কোনো অস্ত্র থাকে না। দেশটাকে এমন রাখতেই হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের হাজারো চাপের পরও ইরাক যুদ্ধে যোগ দিতে রাজি হননি নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্ক। তথাকথিত 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে' যোগ দেওয়া মানেই যে হতো নিউজিল্যান্ডে সন্ত্রাসকে আমন্ত্রণ জানানো।

নিউজিল্যান্ড বরং দু হাত বাড়িয়ে পর্যটকদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। কুইন্সটাউন আরও বেশি। এটি যে সত্যিকার অর্থেই 'পর্যটক নগরী'। এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে প্রতিটি হোটেলের লবিতে শয়ে শয়ে ব্রোশিয়ার। পর্যটকদের জন্য কুইন্সটাউন কত কী আয়োজন সাজিয়ে বসে আছে, তার বিবরণ। ছোট্ট শহর, জনসংখ্যা মাত্র সাড়ে আট হাজার। পর্যটকদের সংখ্যা প্রায়ই তার চেয়ে বেশি হয়ে যায়। নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর বিখ্যাত পার্টিতে যোগ দিতে এখনো যেমন হয়ে গেছে কুইন্সটাউনে নামার সময় বিমান থেকে নিচে তাকিয়েই বুঝতে পারছিলাম কারণটা। নিচে কি ওটা শহর, নাকি শিল্পীর আঁকা কোনো ছবি?

সারি সারি পাহাড়ের মাথায় বরফ জমে আছে। রোদ পড়ে ঝকমক করছে তা। ওপাশের জানালা দিয়ে তা দেখার জন্য উকিঝুঁকি মারছি, সেখানে বসা বিশালবপু তরুণ আসন ছেড়ে দিয়ে বলল, 'দেখতে চাও? এখানে চলে আসো। আমি ওপাশে যাই।'

তুমি দেখবে না?

তরুণের মুখে হাসি, 'আমি আর কী দেখব! আমি কুইন্সটাউনেই থাকি।' দু-তিন দিনের জন্য যাঁরা কুইন্সটাউনে আসেন, তাঁদের ওই তরুণকে ঈর্ষা করারই কথা। একদিকে ওয়াকাটিপু লেক, অন্যপাশে পাহাড়-মাঝখানে ছবির মতো এক শহর। রাস্তাতেও পাহাড়ের মতো চড়াই-উতরাই। সিটি সেন্টারে গিয়ে দেখি, একটু দূরেই আকাশছোঁয়া পাশের পাহাড় থেকে উঠছে-নামছে কেবল কার।

এখানে যে কপথর্ন হোটেলস অ্যান্ড রিসর্টে উঠেছি, সেটির রুমের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই সবুজাভ নীল জলের ওয়াকাটিপু লেক, দিগন্তে পাহাড়ের রেখা। চোখ ফেরানো যায় না। রাস্তার ওপারের মিলেনিয়াম হোটেলে উঠেছে বাংলাদেশ দল। বিকেলে শহরে এক পাক ঘুরে এসে মোহাম্মদ আশরাফুল বিহ্বল হয়ে বললেন, 'যেদিকে তাকাই, মনে হয় ভিউকার্ড।

পর্যটকদের টেনে আনতে শুধুই প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে বসে নেই কুইন্সটাউন। রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষের জন্য এখানে হাজারো আয়োজন। কেবল কারে কয়েক হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় ওঠানামা যার মধ্যে নিরীহতম! শরীরে রশি বেঁধে কয়েক শ ফুট ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ার খেলা ‘বানজি জাম্পিং' এখন অনেক দেশেই আছে। তবে ১৯৮৮ সালে এর বাণিজ্যিক ব্যবহারের সূচনা এই কুইন্সটাউনেই। জেট বোটিং, রিভার রাফটিং, স্কাই ডাইভিং...দুঃসাহসী রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষের স্বর্গ এই কুইন্সটাউন। এমনিতেই তো এটির আরেক নাম 'অ্যাডভেঞ্চার ক্যাপিটাল অব দ্য ওয়ার্ল্ড' নয়!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×