সেই রাতে বুলবুলের রুমে

উৎপল শুভ্র

১০ নভেম্বর ২০২১

সেই রাতে বুলবুলের রুমে

বুলবুলের সঙ্গে এই ছবিটা আরও অনেক পরের

বুলবুলের আত্মবিশ্বাস দেখে একটু চমৎকৃতই হয়েছিলাম। পরে শুনেছি, মাঠ থেকে ফেরার পর সেই রাতে হোটেলের লিফটেও নাকি সৌরভ গাঙ্গুলীর কী একটা কথার জবাবে সেঞ্চুরির ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরদিন সত্যি সত্যি সেই সেঞ্চুরি করার পর রাতে হোটেল শেরাটনে বুলবুলের রুমে গেছি। যাওয়ার পর...

দিনশেষে ৭০ রানে অপরাজিত ব্যাটসম্যানের কাছে সবাই সেঞ্চুরির দাবি তোলে। আমার সেই দলে শামিল হয়ে একটু হলেও চাপ বাড়িয়ে দেওয়ার কোনো ইচ্ছাই ছিল না। কখনো এই জাতীয় কিছু করিও না। অথচ অভিষেক টেস্টের দ্বিতীয় দিন শেষে আমিনুল ইসলাম বুলবুলের প্রথাগত সংবাদ সম্মেলনের পর তাঁকে একটু আলাদা করে নিয়ে কেন যেন জিজ্ঞেস করে বসলাম, 'কী, সেঞ্চুরি পাবেন কাল?'

উত্তর কী হবে, তা তো জানাই। 'দেখা যাক', 'চেষ্টা তো করবই' এই জাতীয় কিছু ছাড়া আর কীই-বা হবে! বুলবুলের উত্তরটা তাই একটু চমকেই দিয়েছিল, 'আমার মন বলছে, হয়ে যাবে। বছর পাঁচেক আগে এই মাঠেই ইংল্যান্ড 'এ' দলের বিপক্ষে তিন দিনের ম্যাচে আমি দিনশেষে ৬৬ না ৭০ রানে অপরাজিত ছিলাম। পরদিন সেঞ্চুরি পেয়েছি, এবারও মনে হয় পাবো।'

বুলবুলের আত্মবিশ্বাস দেখে একটু চমৎকৃতই হয়েছিলাম। পরে শুনেছি, মাঠ থেকে ফেরার পর সেই রাতে হোটেলের লিফটেও নাকি সৌরভ গাঙ্গুলীর কী একটা কথার জবাবে সেঞ্চুরির ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরদিন সত্যি সত্যি সেই সেঞ্চুরি করার পর রাতে হোটেল শেরাটনে বুলবুলের রুমে গেছি। পত্রিকা বন্ধ, কোনো কাজ নেই। হোটেলে যাওয়া অবশ্য শুধুই আড্ডার উদ্দেশ্যে নয়, বুলবুলের একটা ইন্টারভিউ করাও ছিল কার্যতালিকায়। এটির ভার যত দূর মনে পড়ে আমার তখনকার সহকর্মী মোস্তফা মামুনের ওপর ছেড়ে দিয়ে আমি নির্ভেজাল আড্ডাই মেরেছিলাম। তখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও ক্রিকেটাররা হোটেল রুম শেয়ার করে। বুলবুলের চিরকালীন রুমমেট আকরাম খান। বাংলাদেশ দলে এমন আরও দুটি রুমমেট জুটির কথা মনে পড়ছে। মিনহাজুল আবেদীন নান্নু আর আতহার আলী খানও একে অন্যের অনেক বছরের বাঁধা রুমমেট ছিলেন। পরে যেমন জুটি বাঁধেন এনামুল হক মনি ও  সাইফুল ইসলাম।

শতকের পথে!

সেই রাতে বুলবুলের রুমে আড্ডায় একটা দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে। ব্যাট নিয়ে শ্যাডো ড্রাইভ করতে করতে আকরাম খান বুলবুলকে বলছেন, 'আজ তুই সেঞ্চুরি মেরেছিস্। এরপর আমি মারব।' জীবনের প্রথম টেস্ট ইনিংসের শুরুতে আকরাম কিন্তু বুলবুলের চেয়ে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলেন। অভিষেক টেস্টের আগের বেশ কিছুদিন দুজনের ফর্মও ছিল পুরো বিপরীত। কারটা কেমন, তা বোধ হয় না বললেও চলছে। আকরামের অবশ্য টেস্ট সেঞ্চুরি আর পাওয়া হয়নি, এমনকি হাফ সেঞ্চুরিও না। সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। অন্য কোনো সময় এ নিয়ে কথা বলা যাবে। আপাতত বুলবুলেই থাকি। 

আমি থাকতেই থাকতেই বুলবুলকে অভিনন্দন জানাতে রুমে এলেন ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশ দলের সাফল্যের নেপথ্য দুই রূপকার গাজী আশরাফ হোসেন লিপু ও গর্ডন গ্রিনিজ। দুজনের কেউই তখন দলের সঙ্গে নেই। ১৯৯৮ কমনওয়েলথ গেমসে ব্যর্থতার পর দেশে ফিরেই ম্যানেজারের পদ ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন লিপু আর আগের বছর বিশ্বকাপে বাংলাদেশের শেষ ম্যাচের আগে গ্রিনিজকে বিতর্কিতভাবে বিদায় করে দেওয়ার গল্প তো সবারই মোটামুটি জানা। সমস্যাটা বেঁধেছিল বিসিবির টেস্ট স্ট্যাটাস চাওয়ার যৌক্তিকতা নিয়েই। তারপরও অভিষেক টেস্টে বিসিবির আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েছেন গ্রিনিজ। বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসেই ৪০০ করে ফেলায় তাঁকে খুব খুশিও মনে হচ্ছে।

গর্ডন গ্রিনিজের সঙ্গে আরও অনেকের সঙ্গে বুলবুল। ১৯৯৯ বিশ্বকাপের প্রস্তুতির সময় বিকেএসপিতে

বুলবুলের ব্যাটিংয়ে খুব গোছানো একটা ব্যাপার ছিল। ছন্দে আছেন কি নেই, তা বোঝারও সহজ একটা উপায় ছিল। স্পিনারদের বিপক্ষে ক্রিজ থেকে বেরিয়ে এসে এক্সস্ট্রা কাভারের ওপর দিয়ে ড্রাইভ অথবা প্যাডল সুইপ ছিল তাঁর আত্মবিশ্বাসের নির্দেশক। আগের দিন হাফ সেঞ্চুরিতে পৌঁছেছেন বাঁহাতি স্পিনার সুনীল যোশির বলে এমনই একটা এক্সস্ট্রা কাভার ড্রাইভে। পরদিন রাতেও গ্রিনিজ যেটির প্রসঙ্গ তুলে বললেন, 'ওই শটটাই বুঝিয়ে দিয়েছে, তুমি আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছ।'

আমি বললাম, 'এটা তো বুলবুলের পেট শট।'

গ্রিনিজের জবাবটা বুঝিয়ে দিল এই টেস্টের আগে অনেকদিন স্থায়ী দুঃসময়টাকে, 'পেট শট! গত দেড় বছরে ও এই শট খেলেছে কি না সন্দেহ!'

গ্রিনিজ এমনিতে খুব মুডি ছিলেন। তবে সেই মুডের দোলাচল সাংবাদিকদের ক্ষেত্রেই বেশি ঘটত। হাসি-ঠাট্টা-দুষ্টুমিতে ক্রিকেটারদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা ছিল বন্ধুর মতোই। সেই রাতেও যেমন বুলবুলের সঙ্গে ভালোই খুনসুটি হলো। অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি করেছিলেন গ্রিনিজও, তবে তা দ্বিতীয় ইনিংসে। যা করার পর প্রথম ইনিংসে ৯৩ রানে রান আউট হয়ে যাওয়ার আক্ষেপটা তাঁর আরও বেড়েছে। তখন পর্যন্ত টেস্ট অভিষেকে দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরির কীর্তি ছিল শুধুই লরেন্স রোর।

অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরির পর আমিনুল ইসলাম বুলবুল

বুলবুলের সঙ্গে খুনসুটিটা হলো অভিষেকে সেঞ্চুরি নিয়েই। নিজে থেকেই বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে আমি বুলবুলের পক্ষে রায় দিয়ে দিলাম।  'আপনি আপনার অভিষেকে সেঞ্চুরি করেছেন, আর বুলবুল করেছে নিজের দেশের অভিষেকে, বুলবুলই তাই এগিয়ে। তার ওপর আপনার সেঞ্চুরি দ্বিতীয় ইনিংসে, বুলবুলেরটা টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম ইনিংসেই'...হাসি মুখে দেওয়া আমার এই যুক্তি 'ইউ আর রাইট' 'ইউ আর রাইট' বলে হাসি মুখেই মেনে নিলেন গ্রিনিজ। বুলবুলের কাছে হেরে যেতেও যে তাঁর তখন ভালো লাগছে।

সেই রাতের গল্প মোটামুটি বলা হলো। যা লিখতে লিখতে রীতিমতো আফসোস হচ্ছে, কেন একটা ছবি তুলে রাখলাম না! আফসোস করলে তো আরও করা যায়। এমনিতে অটোগ্রাফ নেওয়ার অভ্যাস নেই বললেই চলে। কিন্তু এমন একটা ইতিহাস গড়ার দিনটির চিহ্ন রাখতে বুলবুলের একটা অটোগ্রাফ নিয়ে রেখেছিলাম। কোনো একটা নোটবুকেই হবে। অথচ এই লেখাটা লিখতে বসার আগে তন্নতন্ন করে খুঁজেও সেই নোটবুকটা পেলাম না। পেলে অটোগ্রাফটা স্ক্যান করে দিয়ে দেওয়া যেত সবার জন্য।

থাক, আফসোস করে আর কী হবে! অনিত্য এই জগতে সবই তো হারিয়ে যায়। কোনোটা আগে আর কোনোটা পরে।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×