আহ্, সেন্ট ভিনসেন্ট!

উৎপল শুভ্র

১৮ মে ২০২১

আহ্, সেন্ট ভিনসেন্ট!

আমার কাছে সেন্ট ভিনসেন্ট` নামটাই স্মৃতিকাতর করে তোলা এক রোমান্টিসিজম। ২০০৪ সালে এই সেন্ট ভিনসেন্ট দিয়েই প্রথম ক্যারাবিয়ান দর্শন। পাঁচ বছর পর আবার সেখানে গিয়ে দেখি, ই.. টি. জশুয়া বিমানবন্দরটা সেই একই রকম আছে, রাস্তাঘাটও সামান্যতম বদলায়নি। ক্রিস্টাল হাইটস্ গেস্ট হাউসটা ভেতরে একটু রূপ বদলালেও বাইরে থেকে ঠিক তেমনই। ভার্জিনিয়া ফিলিপসও যে তেমনই আছেন! গেস্ট হাউসের বারান্দায় বসলে সামনের অপরূপ সৌন্দর্যও তা-ই।

প্রথম প্রকাশ: ৮ জুলাই, ২০০৯। প্রথম আলো।

সেন্ট ভিনসেন্টে পা রেখেই মনে হলো, অনেক দিন পর যেন বাড়িতে ফিরলাম!

অবাক হচ্ছেন তো? লাইনটা লেখার পর আমার নিজেরও একটু অবাকই লাগছে। কেন, এমন মনে হবে কেন? বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের এক দ্বীপদেশ কেন বাড়িতে ফেরার অনির্বচনীয় অনুভূতিতে আচ্ছন্ন করবে?

কারণ একটাই। আমার কাছে সেন্ট ভিনসেন্ট' নামটাই যে স্মৃতিকাতর করে তোলা এক রোমান্টিসিজম। পাঁচ বছর আগে এই সেন্ট ভিনসেন্ট দিয়েই প্রথম ক্যারাবিয়ান দর্শন। বাংলাদেশের ক্রিকেটেরও। ওয়েষ্ট ইন্ডিজে এখানেই প্রথম এসেছিল বাংলাদেশের কোনো দল। ওয়েস্ট ইন্ডিজে আসছি শুনে সে দলের অধিনায়ক হাবিবুল বাশারও তাই স্মৃতিকাতর, 'আহ্, আবার সেন্ট ভিনসেন্ট! কী যে ভালো লেগেছিল!'

ই.. টি. জশুয়া বিমানবন্দরটা সেই একই রকম আছে, রাস্তাঘাটও সামান্যতম বদলায়নি । ক্রিস্টাল হাইটস্ গেস্ট হাউসটা ভেতরে একটু রূপ বদলালেও বাইরে থেকে ঠিক তেমনই। ভার্জিনিয়া ফিলিপসও যে তেমনই আছেন!

ক্রিস্টাল হাইটস্ গেস্ট হাউসের সেই বারান্দা। সামনে অবারিত সাগর

এক মেয়ে আর তিন ছেলে ইংল্যান্ডে থাকেন। নিজেও ত্রিশ বছর ইংল্যান্ডে কাটানোর পর ১৯৯৪ সালে মাতৃভূমিতে ফিরে বানিয়েছেন এই গেস্ট হাউস। সেটিতে ৬০ বছরের স্থূলকায় কৃষ্ণাঙ্গী আমাকে যেভাবে অভ্যর্থনা জানালেন, তা দেখে কারও মনে হতেই পারত, অনেক দিন পর বাড়িতে ফেরা ছেলেকে দেখছেন কোনো মা!

ঘটনাচক্রে ২০০৪ সালে যে ঘরটিতে ছিলাম, এবারও সেটিই আমার নামে বরাদ্দ। রাবিদ ইমামের কথা খুব মনে পড়ল, মাহমুদুল হাসান শামীমের কথাও। ২০০৪ সালে বাংলাদেশ দলের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের সময় সঙ্গী ছিলেন ওই দুই সাংবাদিক। ক্রিস্টাল হাইটস্ আবিষ্কারের কৃতিত্বটাও রাবিদ ইমামের। ইন্টারনেটে ও-ই দেখে রেখেছিল ঠিকানাটা। পৌঁছেছিলাম অনেক রাতে। সাগরের গর্জন শুনেছি, কিন্তু সেটি যে এত কাছে, তা বুঝেছি পরদিন সকালে ঘুম ভাঙার পর। ক্যারাবিয়ানের অপূর্ব নৈসর্গের সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয়ের সেই প্রথম অনুভূতিটা এখনো ভুলতে পারি না।

সেই সেন্ট ভিনসেন্ট, সেই ক্রিস্টাল হাইটস্, সেই ভার্জিনিয়া ফিলিপস, সেই একই রুম—বাড়ি ফেরা অবশ্যই নয়, তবে বাড়ি ফেরার মতো তো মনে হতেই পারে, তাই না?

গেস্ট হাউসের বারান্দায় বসে বাঁয়ে তাকালেই ই. টি, জশুয়া এয়ারপোর্ট

ক্যারাবিয়ান সাগরে ৪৫ মাইল পর্যন্ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ৩০টি দ্বীপ নিয়ে এই সেন্ট ভিনসেন্ট। ও হো, ভুল হয়ে গেল। সেন্ট ভিনসেন্ট এই ৩০ দ্বীপের মধ্যে সবচেয়ে বড় বলে সংক্ষেপে এ নামটাই বলে সবাই। সোভিয়েত ইউনিয়ন যেমন একসময় আমাদের কাছে ছিল রাশিয়া। বাকি ২৯টি দ্বীপ মিলে দেশের নাম সেন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড গ্রেনাডাইনস্। হাজার বছর আগে অগ্ন্যুৎপাতে সাগরের বুকে ভেসে ওঠা ভূখণ্ড, সেন্ট ভিনসেন্টের রাজধানী শহর কিংসটাউন তাই ঠিক যেন দার্জিলিং। চড়াই-উতরাইয়ের রাস্তা, টিলার ওপর ছোট ছোট বাড়ি।

ঠিক সাগরের কোল ঘেঁষে এমনই এক টিলার ওপর ক্রিস্টাল হাইটস্ গেস্টহাউস। তিনতলা গেস্টহাউসের সবচেয়ে ওপরে আপাতত আমি একাই অতিথি। পরশু সন্ধ্যায় বারবাডোজ থেকে পৌঁছানোর পর অনেক রাত পর্যন্ত বারান্দায় বসে থাকার সময় একটু তাই ভয়-ভয়ও করল। হু হু বাতাস বইছে। সুনসান নীরবতার সঙ্গে লড়ে যাচ্ছে শুধু গোঙানির মতো শোনানো সাগরের ঢেউ ভাঙার শব্দ আর ঝিঁঝি পোকার ডাক। ভয় ভয় লাগছে, আবার এই অপরূপ সৌন্দর্যের সামনে থেকে সরে যেতেও ইচ্ছে করছে না।

গগনে পূর্ণ শশী (আকাশ আর চাঁদে মায়াবী ভাবটা ঠিক বোঝানো যাবে বলে মনে হলো না!), সাগরের বুকে ছায়া পড়েছে তার। বাঁ পাশে তাকালেই দেখছি হাজারো জোনাকি। না, জোনাকি হলে তো জ্বলবে নিভবে। ওসব কিংসটাউন শহরের বাতি বলে নিষ্কম্প। যেখানে বসে আছি, একটু পরপর আলোকখচিত বড় বড় পাখি এসে নামছে ঠিক তার সামনে দিয়ে। ক্রিস্টাল হাইটসের গা ঘেঁষেই যে ই. টি. জশুয়া বিমানবন্দর। বড় পাখির মতো ছোট ছোট বিমান এমনভাবে উড়ে যায় যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে।

মধুচন্দ্রিমার জন্য পছন্দের দ্বীপ। নাম ইয়াং আইল্যান্ড

মঙ্গলবার সকালে সেই বারান্দায় বসেই লিখছি এই লেখা। সাগরে দিকে তাকিয়ে মাঝেমধ্যেই থমকে যাচ্ছে কি-বোর্ডে আঙুল। একটু দূরে সাগর ফুঁড়ে উঠে গেছে বিশাল এক ঢিবি। তার পাশেই সবুজে মোড়া ছোট্ট একটা দ্বীপ। কিংসটাউনের এত কাছে, কিন্তু সেটির আবার অন্য নাম–ইয়াং আইল্যান্ড। মধুচন্দ্রিমা করতে তরুণ দম্পতিদের পছন্দের 'তরুণ দ্বীপ'!

দূরে পাল তোলা সাদা ইয়টগুলোকে দেখাচ্ছে রাজহংসের মতো। উড়ে বেড়ানো পাখিগুলোও সব ধবধবে সাদা। সেগুলোকে সচকিত কলে এইমাত্র উড়ে গেল সাদা একটা যন্ত্রপাখি। নাহ্, এই সুন্দরের বর্ণন আমার কম্মো নয়। এ জন্য কবি-সাহিত্যিক হতে হয়!

৭ জুলাই, ২০০৯। সেন্ট ভিনসেন্ট।

 

আরও পড়ুন:

ক্যারিবীয় কড়চা-১: আজি আঁখি জুড়াইল...
ক্যারিবীয় কড়চা-২: এখানে সন্ধ্যা, ওখানে প্রভাত
ক্যারিবীয় কড়চা-৩: বারবাডোজ যেখানে আলাদ
ক্যারিবীয় কড়চা-৪: সোবার্স-উইকস সন্ধ্যা

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×