মসলা-দ্বীপ

উৎপল শুভ্র

২৯ মে ২০২১

মসলা-দ্বীপ

ফ্লাইট বিভ্রাটের কারণে সেন্ট ভিনসেন্ট থেকে সরাসরি আসার পরিবর্তে ত্রিনিদাদ ঘুরে শেষ পর্যন্ত এলাম গ্রেনাডায়। পাঁচ বছর আগেও যা মনে হয়েছিল, এবারও তা-ই মনে হলো। সেন্ট ভিনসেন্ট যেখানে একটা বড় গ্রামের মতো, গ্রেনাডা অনেক বেশি শহুরে। রাজধানী শহরের নাম সেন্ট জর্জেস, যে শহরের মাঝে ঢুকে গেছে হারবার। আর দ্বীপটা বিখ্যাত মসলার জন্য, যে কারণে এর অন্য নাম `মসলা-দ্বীপ।

ভোর-ভোর ওঠো...হাত-মুখ ধুয়েই লিখতে বসে ছাত্রজীবনের স্মৃতি ফিরিয়ে আনো...দুটি লেখা পাঠিয়ে ঝড়ের বেগে তৈরি হয়ে মাঠে যাও...লাঞ্চের পর এক ঘণ্টার মধ্যে নগর সংস্করণের জন্য একটা লেখা পাঠাও...খেলা শেষে খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা-বার্তা বলে হোটেলে ফেরো সন্ধ্যা সাতটায়...পরদিন সকালের লেখাটা গুছিয়ে খেয়ে-দেয়ে ক্লান্তিতে জড়িয়ে আসা দুই চোখকে ঘুমে জড়াতে দাও...আবার ভোরে ওঠো...

এই চক্রের মধ্যেই চলছে জীবন। প্রতিটি দিনই একই রকম—কড়চাটা চালিয়ে যাওয়াই কঠিন হয়ে যাচ্ছে রে ভাই! অখ্যাত এক সাংবাদিকের দিনলিপি পড়ার কী দায় পড়েছে পাঠকের, তার ওপর যদি তাতে কোনো নতুনত্ব না থাকে! ক্যারিবীয় কড়চা লিখতে তো ক্যারfবিয়ান দেখতে হবে। তার সময় কই?

শুধু ক্রিকেটটাই এর মধ্যে ব্যতিক্রমের ছোঁয়া। টেস্ট ক্রিকেটের একটি দিনও অন্য দিনের মতো নয়; প্রতিটি বল আর বলের পরের ঘটনাক্রমও আলাদা। এই সিরিজটাও হচ্ছে দুর্দান্ত। টেস্ট র‍্যাঙ্কিংয়ের তলানিতে পড়ে থাকা বাংলাদেশ আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বিতীয় দলের (এটা লিখেছি জানলে ফ্লয়েড রেইফার নিশ্চিত রেগে যাবেন!) খেলা বলে ক্রিকেট বিশ্ব মুখ ফিরিয়ে, কিন্তু এক দিক থেকে তো তা ভালোই হয়েছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের আসল দল খেললে কি আর সেন্ট ভিনসেন্টের পর গ্রেনাডাও এমন তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার রোমাঞ্চ উপহার দিতে পারত!

খেলার উত্তেজনায় মিল আছে, নইলে সেন্ট ভিনসেন্ট আর গ্রেনাডায় অনেক পার্থক্য। সেন্ট ভিনসেন্ট যেন বড় একটা গ্রামের মতো। গ্রেনাডা ক্যারিবিয়ানের সবচেয়ে গরিব দেশগুলোর মধ্যে একটি হয়েও সে তুলনায় অনেক বেশি নাগরিক। নৈসর্গিক সৌন্দর্যে অবশ্য অনেকটা একই রকম। পাহাড়-সাগর-সৈকত...পাহাড়ের গায়ে গায়ে বাড়ি। পার্থক্য বলতে গ্রেনাডার রাজধানী সেন্ট জর্জেসের মাঝখানে সাগরের একটা অংশ ঢুকে হারবার (বাংলাটা পোতাশ্রয়, তবে ইংরেজিটাই বেশি সহজবোধ্য?) হয়ে গেছে, সেটিতে ভাসছে অসংখ্য বোট। কোনোটা ভাড়া যায়, কোনোটা বা ইউরোপ-আমেরিকার কোনো ধনকুবেরের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। বছরে দু-একবার ছুটি কাটাতে এসে ব্যবহার করবেন বলে কিনে রেখেছেন। সেটি দেখাশোনা করে কর্মসংস্থান হচ্ছে কিছু গ্রেনাডিয়ানের।

গ্রেনাডার রাজধানী সেন্ট জর্জেসের মাঝখানে ঢুকে পড়েছে এই হারবার

প্রতিদিন সকালে হোটেল থেকে মাঠে আসি ওই হারবারের পাশ দিয়েই। নীল হারবারে সাদা বোট, পেছনে পাহাড়—কী যে সুন্দর, কী যে সুন্দর...চোখ ফেরানো যায় না। ট্যুরে এলে সবচেয়ে ভালো বন্ধুত্ব হয় ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে। সেন্ট ভিনসেন্টে ছিল বার্ট উইলিয়ামস, এখানে রয় স্যামুয়েল। হোটেল আর মাঠ করে কড়চা লেখার উপকরণ জোগাড় করতে না পারার সমস্যাটা তাঁকেই খুলে বললাম। স্যামুয়েল সহজ সমাধান দিয়ে দিল, ‘কেন, বিচ নিয়ে লেখো!’

বিচ আর কত! বারবাডোজ থেকে তা অনেক লিখেছি। স্যামুয়েলের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি, ‘ধুর, বারবাডোজের বিচ আর গ্রেনাডার বিচ! গ্রেনাডার মতো বিচ পৃথিবীতে আর কোথাও নেই।’ ক্যারিবিয়ানের যে দেশেই যান, এই একটা জিনিস কমন। এই দ্বীপের মতো আর কোনো দ্বীপ নেই। এই দ্বীপের সৈকতের মতো আর কোনো সৈকতও। এই দাবিতে প্রভাবিত না হয়ে নির্মোহ বিচারকের চোখে দেখলে ক্যারিবিয়ানের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ বারবাডোজই বেশি নম্বর পাবে। কিন্তু সেটি কেউ মানলে তো! সেন্ট ভিনসেন্টেই যেমন এক তরুণ বারবাডোজের রুপালি বালুর সৈকতে আমার মুগ্ধতার কথা শুনে অবলীলায় বলেছিল, ‘বারবাডোজে তো কালো বালুর বিচ নেই। সেটি আছে শুধু সেন্ট ভিনসেন্টেই।’

কালো বালুর সৈকতের অনন্যতা থাকতে পারে, কিন্তু সেটি কীভাবে রুপালি বালুর সৈকতের চেয়ে সুন্দর হয়—এটা একটা প্রশ্ন বটে। এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে ওই গানের লাইনে, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি...’

বিচ-টিচ নিয়ে আর লিখব না জানানোর পর স্যামুয়েলের দ্বিতীয় প্রস্তাব, ‘তাহলে মসলা নিয়ে লেখো।’ মসলা? মসলা নিয়ে লেখার কী আছে? আছে, আছে, গ্রেনাডা নিয়ে কিছু লিখলে তো অবশ্যই আছে। গ্রেনাডার অন্য নামই যে মসলা-দ্বীপ—‘দ্য স্পাইস আইল্যান্ড!’

বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ জায়ফলই উৎপন্ন হয় গ্রেনাডায়

এলাচ-দারুচিনি-লবঙ্গ-মরিচ...সবকিছুই হয় গ্রেনাডায়। সবচেয়ে বেশি হয় জায়ফল। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ জায়ফলই উৎপন্ন হয় এখানে। জায়ফলের ইংরেজি ‘নাটমেগ’ তাই দেশটির প্রায় জাতীয় প্রতীকের মতো। শহরের মধ্য দিয়ে আসার পথে প্রতিদিন নাটমেগ রেস্টুরেস্ট-নাটমেগ বার-নাটমেগ ক্রাফটস—এমন অনেক সাইনবোর্ড চোখে পড়ে।

গ্রেনাডার রাজস্বের সবচেয়ে বড় উৎস পর্যটন, এর পরই মসলা। শহরের বাইরে মাইলের পর মাইল সেই মসলা-বাগান নাকি দেখার মতো একটা জিনিস। পর্যটকদের তা দেখিয়ে পয়সা কামানোর জন্য ‘স্পাইস ট্যুর’ও আছে। দেখি, মঙ্গলবার সেটিতে শামিল হতে পারি কি না! বাংলাদেশের জয়ের প্রার্থনা তো করছিই। তার চেয়েও বেশি করছি, বৃষ্টি এসে বাগড়া দিয়ে টেস্ট ম্যাচটা যেন পঞ্চম দিনে নিয়ে না যায়!

মঙ্গলবার যেন টেস্টের পঞ্চম দিন না হয়, হয় আমার গ্রেনাডা দেখার দিন!

১৯ জুলাই ২০০৯, গ্রেনাডা।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×