মসলা-দ্বীপ থেকে বৃষ্টি-অরণ্যের দেশে

উৎপল শুভ্র

৩০ মে ২০২১

মসলা-দ্বীপ থেকে বৃষ্টি-অরণ্যের দেশে

গ্রেনাডা থেকে ডমিনিকা। যার মানে মসলা-দ্বীপ থেকে বৃষ্টি-অরণ্যের দ্বীপে। সেই যাত্রাপথটা একটা অভিজ্ঞতা বটে। এর আগের দিন গ্রেনাডা চষে বেড়ানোর অভিজ্ঞতাটা আরও স্মরণীয় হয়ে আছে। লুইস হ্যামিল্টনের দাদার বাড়ি থেকে গ্র্যান্ড ইটাং লেক, রাস্তার দুই পাশে জায়ফল, দারচিনি, এলাচ গাছ দেখতে দেখতে এক সময় তা আমাদের দেশে আম-কাঁঠাল গাছ দেখার মতো হয়ে যাওয়া, দুই গাছে বাঁধা দোলনায় শুয়ে পাহাড়ি কলা খাওয়া..আহা!

গ্রেনাডা থেকে ডমিনিকা অনেক দূর—৪৫৫৮ মাইল। তাই বলে বিমানে আসতেও সাত ঘণ্টা লাগবে?

না ভাই, সব কিছুতে লিয়াটের (ক্যারাবিয়ানের অভ্যন্তরীণ বিমান সংস্থা) দোষ ধরবেন না। এমনিতেও সাড়ে চার ঘণ্টা লাগত। সামান্য একটু বেশি লেগেছে। সামান্যই! লিয়াটে যাঁদের চড়তে হয়, আড়াই ঘণ্টা দেরিকে তাঁরা কোনো দেরিই মনে করেন না। গ্রেনেডা বিমানবন্দরে এক সহযাত্রী তো তৃতীয়বার ক্যারিবিয়ানে এসেও লিয়াটের পুরো অর্থটা জানি না দেখে বিস্ময় প্রকাশ করলেন। LIAT মানে নাকি লিভ আইল্যান্ড অ্যাট অ্যানি টাইম!

গ্রেনাডা থেকে ডমিনিকায় সরাসরি ফ্লাইট নেই। পরশু আমার যাত্রাপথ এ রকম—গ্রেনাডা থেকে সেন্ট ভিনসেন্ট হয়ে অ্যান্টিগা। সেখানে বিমান বদলে গুয়েডালোপ হয়ে ডমিনিকা। মজাটা হলো, সেন্ট ভিনসেন্ট থেকে অ্যান্টিগা যাওয়ার সময় আমরা ডমিনিকার ওপর দিয়েই উড়ে গেলাম। আরে ভাই, একটু সাইড করে নামিয়ে দিয়ে গেলে কী হতো!

আসল মজাটা হলো অ্যান্টিগায় (পরে ভাবতে মজাই লাগে)। ৪০ মিনিটের যাত্রা-বিরতিকে দুই ঘণ্টা বানিয়ে দেওয়ার পর বিমানে চড়ার ডাক পেয়ে যখন লাইনে দাঁড়িয়ে, ছয়-সাতজন যাত্রী বাকি থাকতেই বিস্ময়কর এক ঘোষণা—প্লেন নাকি ভরে গেছে! কী বলে, এটা কি লোকাল বাস নাকি! বোর্ডিং পাস হাতেও শুনতে হবে প্লেনে আর জায়গা নেই! এই সময় যাত্রীদের তুমুল চিৎকার-চেঁচামেচি করার নিয়ম। এখানে নিয়মের ব্যতিক্রম হলো। কারণ জানা গেল, মিনিট দশেক পরই আরেকটা ফ্লাইট আছে এবং সেটি গুয়েডালোপ না হয়ে সরাসরি ডমিনিকা যাবে। ভালোই তো, গুয়েডালোপে গিয়ে আবার কি-না-কি ঝামেলায় পড়তে হয়!

সেই ফ্লাইটটা ভালোমতোই ছাড়ল। প্রতিবারই চেক-ইন করার সময় যে সবুজ স্যুটকেসটাকে ‘আর কী হবে দেখা’ ভঙ্গিতে তাকিয়ে বিদায় দিই, অবাক করে দিয়ে সেটিও ডমিনিকা বিমানবন্দরের ঘূর্ণায়মান বেল্টে! লিয়াটের প্রতি শ্রদ্ধাই বেড়ে গেল। 

দেখো কাণ্ড, কী লিখব বলে বসেছি আর কী লিখে চলেছি! আসলে গন্তব্যে পৌঁছেই জরুরি কোনো কাজ না থাকলে লিয়াটে ভ্রমণ এমনই বিনোদন যে, তা নিয়ে লেখার লোভ সামলানো কঠিন। তা কী যেন লিখতে বসেছিলাম?

ও হ্যাঁ, শেষ দিনের গ্রেনাডা আর প্রথম দর্শনের ডমিনিকা। ঘটা করে পুরো জাতিকে জানিয়েছি (ফালতু কথা, পুরো জাতিই প্রথম আলো পড়ে নাকি, আর পড়লেও এই ফালতু কড়চা?), টেস্ট চার দিনে শেষ হলে পঞ্চম দিনটা হবে গ্রেনাডা দেখার দিন। মাঝখানে দুদিন আর কড়চা লেখার সময় হয়নি, বাংলাদেশের সিরিজ জয়ের পর তা নিয়ে চারটা লেখা লিখতেই জীবন প্রায় এবং সময় পুরো শেষ! পরদিন তো ভোর পাঁচটায় বিমানবন্দরেই যাত্রা।

তবে গ্রেনাডাটা মোটামুটি দেখা হয়েছে। তাতে অবশ্য এক সহকর্মীর বড় অবদান। ঘুম ভালো না গ্রেনাডা দেখা ভালো—এই দোদুল্যমানতায় দুলতে দুলতে ফেসবুকে স্ট্যাটাস লিখেছিলাম, ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু...। প্রথম আলোর ক্রীড়া বিভাগে নবাগত আরিফ রনি অন্ত্যমিল দিয়ে মন্তব্য লিখলেন, তাহলে আর গ্রেনাডা দেখা হবে না কভু। তাই তো, ঘুম তো জীবনে অনেক ঘুমানো যাবে। আর কোনো দিন গ্রেনাডা আসা হবে কি না কে জানে!

বীরবিক্রমে (বীর উত্তমে লিখলে আরও উচ্চমার্গের হতো, কিন্তু সেটি বোধ হয় ঠিক অর্থবোধক হয় না) তাই বেলা তিনটার দিকে ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। হাতে ঘণ্টা চারেক সময়, যতটুকু দেখা যায়। দৈর্ঘ্যে ১০ আর প্রস্থে ১২ মাইলের গ্রেনাডার এক-চতুর্থাংশ দেখা হয়ে গেল তাতেই। গ্রেনাডা যে কারণে বিখ্যাত, সেই মসলা-বাগান আর বৃষ্টি-অরণ্যের দিকটাই বেছে নিয়েছিলাম। যাওয়ার পথে বোনাস হিসেবে পেয়ে গেলাম লুইস হ্যামিল্টনের দাদার বাড়ি।

ফর্মুলা ওয়ান রেসার লুইস হ্যামিল্টনের দাদার বাড়ি দেখে এসেছি গ্রেনাডায়

ক্যারিবিয়ানের বেশির ভাগ দ্বীপের মতোই গ্রেনাডার দখল নিয়েও ইংরেজ আর ফরাসিরা অনেক মারামারি করেছে। দেশটা জুড়ে তাই ইংরেজি আর ফরাসি নামের সহাবস্থান। ফর্মুলা ওয়ান রেসিংয়ের এই সময়ের সবচেয়ে বড় তারকা লুইস হ্যামিল্টনের দাদার বাড়ির এলাকাটার নামই যেমন ফরাসি—গ্র্যান্ড রয়।

হ্যামিল্টনের ইংল্যান্ডেই জন্ম। তাঁর দাদার এখনো গ্র্যান্ড রয়েই বাস। হ্যামিল্টনও নাকি বছরে দু-তিনবার আসেন। এ বছরই কিছুদিন আগে এসেছিলেন গ্রেনাডার স্বাধীনতা লাভের ৩৫তম বার্ষিকীতে বিশেষ অতিথি হয়ে। গ্রেনাডায় তাঁর একটা বিলাসবহুল হোটেলও আছে। ট্যাক্সি ড্রাইভার-কাম-গাইড রয় স্যামুয়েল হ্যামিল্টনের ফর্মুলা ওয়ান জয়ে গ্রেনাডার অবদান বোঝাতে দাবি করল, এই আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তাতে প্র্যাকটিস করেই নাকি হ্যামিল্টন আজকের হ্যামিল্টন হতে পেরেছেন। 

ক্যারিবিয়ানে গ্রেনাডার পরিচিতি মসলা-দ্বীপ নামে—এটা তো বোধ হয় আগেই জানিয়েছি। তবে মসলা-বাগান দেখে একটু ধাক্কাই খেলাম। দারুচিনি-এলাচ-জায়ফল এসব গাছই তো জীবনে দেখিনি, কল্পনার সঙ্গে মিলবে কীভাবে? আমি যেমন ভেবেছিলাম, বাংলাদেশে সবজি বাগানের মতো মাইলের পর মাইল গাছের সারি দেখব—ব্যাপারটা একদমই তা নয়।

উঁচু-নিচু এমন সরু রাস্তার দুই পাশে হরেক রকম মসলার বাগান

মাইলের পর মাইল ঠিক আছে, তবে সেটি রাস্তার দুই পাশে লম্বালম্বি। বাগান শব্দটাও ঠিক যাচ্ছে না, আসল রাস্তার পাশ থেকে উঠে যাওয়া পাহাড়ি জঙ্গল। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ জায়ফল উৎপন্ন হয় গ্রেনাডাতে, জায়ফল গাছের তাই ছড়াছড়ি। দারুচিনি গাছও পেলাম অনেক। একটা থেকে একটু ছাল কেটে সংগ্রহেও রেখে দিলাম। নখ দিয়ে খুঁটলে গন্ধটা টের পাওয়া যায়, তবে মুখে দিয়ে দেখি নিমতেতো। শুকানোর পর না এই সবুজ গাছের ছালটা খয়েরি দারুচিনি হবে। গাছগুলো বেশ বড় বড়। যেমন ভেবেছিলাম, যেখানে জায়ফল শুধুই জায়ফল বা যেখানে দারুচিনি শুধুই দারুচিনি—ব্যাপারটা এমন নয়। জায়ফল, দারুচিনি, কলাগাছ, পেয়ারা, আম—সব জাতের গাছ ভাই-ভাই হয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। এলাচ গাছ লিখলাম না, কারণ এটি মনে হয় একটু দুষ্প্রাপ্য, দুটির বেশি দেখাই পেলাম না।

পাহাড়ি পথ বেয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৯০০ ফুট ওপরে গিয়ে গাড়িটা যেখানে থামল, সামনে তাকিয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল। টলটলে জলের বিশাল এক লেক। যেটি গিয়ে মিশেছে ঘন সবুজ বনে। নাম গ্র্যান্ড ইটাং লেক—স্যামুয়েল জানাল, সকাল-দুপুরে এই জায়গাটা পর্যটকে গিজগিজ করে। আমরা পৌঁছেছি সন্ধ্যা-সন্ধ্যায়, আর কোনো জনমানব নেই। লেকের জলের ওপর একটা মাচামতো আছে, সেখানে মিনিট-দশেক একা বসে থাকার সময় মনে হলো—পৃথিবীটা বড় শান্তির জায়গা।

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৯০০ উপরে স্বচ্ছ জলের এই লেকের নাম গ্র্যান্ড ইটাং। যে মাচাটা দেখছেন, ওটাতে বসে মনে হয়েছিল পৃথিবীটা বড় শান্তির জায়গা

ফেরার পথে গাছ থেকে পাকা কলা আর পেয়ারা পেড়ে খেলাম, পাহাড়ের গা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা স্ফটিক-স্বচ্ছ জল। এক জায়গায় একটু সমতলমতো জায়গায় দুই গাছে বাঁধা একটা দড়ির দোলনা দেখে সেটিতে কিছুক্ষণ শুয়ে পাখির কিচিরমিচির শুনলাম আর দেখলাম সবুজমুখো বানর। মাইলের পর মাইল ঘন সবুজ রেইন ফরেস্ট তো পুরো পথেই পাশে পাশে থাকল। কী বিশাল! ডমিনিকায় আসার পর অবশ্য বুঝলাম, রেইন ফরেস্ট কাহাকে বলে এবং তাহা কত প্রকার ও কী কী! আজ একটু ঘুরে-টুরে দেখে সেই গল্প না হয় পরের কড়চাতে বলি।

শুধু প্রথম দর্শনের অভিজ্ঞতাটাই জানাই আজ। প্লেন যখন নামছে, নিচে শুধু পাহাড় আর পাহাড়! ন্যাড়া-রুক্ষ পাহাড় নয়, ঘন সবুজ পাহাড়। দেশটার নব্বই শতাংশই নাকি এমন অরণ্যময়। যা শুনে এর চেয়েও আশ্চর্য হবেন, এয়ারপোর্ট থেকে শহরে আসতে লাগল পাক্কা সোয়া ঘণ্টা। বাংলাদেশ দলের বাস একটু সাবধানে চলেছে বলে সেটির প্রায় দুই ঘণ্টা। রাস্তাও কী, পাহাড়ে এই ওঠো-এই নামো...নাড়িভুঁড়ি সব উল্টে আসার উপক্রম!

টাকা-পয়সার মতো ‘তুচ্ছ’ ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগে না। তবে এয়ারপোর্ট থেকে শহরে আসতে যে ৭০ মার্কিন ডলার ট্যাক্সি ভাড়া লাগল, এটা জানানোর লোভ সামলাতে পারছি না। এটি যে ভাই রেকর্ড বইয়ে স্থান পাওয়ার মতো!

২৩ জুলাই ২০০৯। ডমিনিকা।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×