স্টিভ ওয়াহ, আপনার না বাংলাদেশে আসার কথা ছিল!

উৎপল শুভ্র

২ জুন ২০২১

স্টিভ ওয়াহ, আপনার না  বাংলাদেশে  আসার কথা ছিল!

কলকাতা বিমানবন্দরে স্টিভ ওয়াহর সঙ্গে সেলফি

এমনই তো বলেছিলেন স্টিভ ওয়াহ। রিয়েল এস্টেটের যে ব্যবসায় জড়িয়েছেন, সেটির কাজেই বছরের শেষ দিকে বাংলাদেশে আসবেন। পরে নিশ্চয়ই পরিকল্পনা বদল হয়েছে, নইলে তো অবশ্যই আসতেন। এলে আমাকে আগেই জানানোরও কথা ছিল। এটা বেঙ্গালুরুর কথা। এর আগে কলকাতা বিমানবন্দরে স্টিভ ওয়াহর সঙ্গে হঠাৎ দেখা এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে এই লেখা।

প্রথম প্রকাশ: ২০ মার্চ ২০১৬। প্রথম আলো।

কে ওটা, স্টিভ ওয়াহ না? 

আগের রাতে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ করে ফিরতে ফিরতে রাত দেড়টা বেজেছে। সকাল ৬টায় বেঙ্গালুরুর ফ্লাইট ধরতে বেরিয়ে পড়তে হয়েছে ভোর ৪টায়। মাঝখানে এক-দেড় ঘণ্টা বিছানায় এপাশ-ওপাশই করেছি, একটুও ঘুম হয়নি। নির্ঘুম চোখে ভুল দেখছি না তো!

না, স্টিভ ওয়াহই।

অস্ট্রেলিয়ার সর্বজয়ী দলের অধিনায়কও একই ফ্লাইটে বেঙ্গালুরু যাচ্ছেন। হাই-হ্যালো করার পর মনে হলো, আমার গলায় তো অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড নেই। পরিচয় না দিয়ে কথা বলাটা অসততা হবে। তা দেওয়ার পর স্টিভ ওয়াহর মুখে ঠোঁট বাঁকানো সেই পরিচিত হাসি, ‘বলার দরকার নেই। কথা বলার ধরন দেখেই বুঝে ফেলেছি। আমি সাংবাদিকদের চিনতে পারি।’

পারলে তো ভালোই। তাহলে মিনিট পাঁচেকের ছোট্ট একটা ইন্টারভিউ হয়ে যাক। স্টিভ মাথা নাড়েন, ‘এই সাতসকালে পাঁচ মিনিট কেন, তিন মিনিটের ইন্টারভিউ দেওয়ারও ইচ্ছা নেই।’

পটানোর চেষ্টা করলাম। আপনার সময়ের যত বিখ্যাত ক্রিকেটার আছে, সবার ইন্টারভিউ করেছি। শুধু আপনিই বাদ আছেন। প্লিজ!

স্টিভ ওয়াহ কি পটার পাত্র? পাল্টা প্রশ্ন, ‘যখন খেলেছি, আমার ইন্টারভিউ করেননি কেন?’

আমি বললাম, ‘বার দুয়েক চেষ্টা করেছিলাম। এর মধ্যে ২০০২ সালে কলম্বোর গ্যালাদারি হোটেলের লবির কথাটা মনে আছে।’

‘আমি কী বলেছিলাম?’

‘রিসেপশন থেকে একগাদা কাগজ হাতে নিয়ে লিফটের দিকে এগোতে এগোতে বলেছিলেন, ‘আই অ্যাম ভেরি বিজি। নো টাইম।’

‘এখনো একই কথা বলব। আই অ্যাম ভেরি বিজি। নো টাইম।’

বলার সময় মুখে হাসি দেখে মনে হলো, ইন্টারভিউ না হোক, টুকটাক কথা বোধ হয় চালিয়ে যাওয়া যাবে।

নিজে থেকেই বললেন, ‘কালকের উইকেটটা ভালো ছিল না। অথচ সৌরভ বলেছিল, এটা নাকি ব্যাটিং উইকেট হবে।’ 

সৌরভ তো এখন সিএবির প্রেসিডেন্ট। এই ম্যাচের আগে এমন ব্যস্ত ছিল...

কথাটা শেষ হওয়ার আগে স্টিভের মুখে ওই হাসিটা, ‘ব্যস্ততা দেখিয়েছে আর কি!’

কথাটা খট করে কানে লাগল। পুরোনো তিক্ততা তাহলে এখনো যায়নি। পনেরো বছর আগের জ্বালা এখনো পোড়ায় স্টিভ ওয়াহকে!  ২০০১ সালের ভারত সফরকে নাম দিয়েছিলেন ‘দ্য লাস্ট ফ্রন্টিয়ার’। ওটাই শুধু জয় করার বাকি ছিল তাঁর। তা আর জয় করা হয়নি। কলকাতায় ফলো অন করেও ভেঙ্কট লক্ষ্মণের ২৮১-ধন্য ভারতের ওই অবিস্মরণীয় জয় থামিয়ে দিয়েছিল স্টিভ ওয়াহর অশ্বমেধ ঘোড়া। চেন্নাইয়ে পরের টেস্টে জিতে সিরিজও জিতে যায় ভারত। ওই সিরিজে স্টিভ ওয়াহকে তাঁর অস্ত্রেই ঘায়েল করেছিলেন সৌরভ। স্লেজিংকে ‘মেন্টাল ডিজইন্টিগ্রেশন’ নাম দিয়ে সেটিকে অন্য মাত্রা দেওয়া স্টিভ ওয়াহকে টসের জন্য অপেক্ষা করিয়ে করিয়ে চূড়ান্ত বিরক্ত করে ছেড়েছিলেন।
বেঙ্গালুরু কেন যাচ্ছেন? 

‘ব্যবসার কাজে।’

তাহলে ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টির জন্য ভারতে আসেননি? 

‘না।’

ও হ্যাঁ, কলকাতার কাগজে আপনার ছবি দেখলাম। উদয়নের বাচ্চাদের সঙ্গে...

‘ওটা চ্যারিটি। আর বেঙ্গালুরুরটা কাজ।’

এই ছবিটাই হয়তো বলে দিচ্ছে, শেষ পর্যন্ত ইন্টারভিউটা হয়েছিল। বেঙ্গালুরুর রিট্জ-কার্লটন হোটেলে
সেই কাজটা কী, সেটিও খুলে বললেন। বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রির মাধ্যম হতে একটা কোম্পানি খুলেছেন। তিনি যেটির চেয়ারম্যান। এর মধ্যেই আবার একটু ক্রিকেট এল। এবার প্রশ্নকর্তা স্টিভ ওয়াহই, ‘কী মনে হয়, বাংলাদেশের চান্স আছে?’

‘চান্স তো আছেই। কাল অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেবে বাংলাদেশ।’

স্টিভ ওয়াহ হাসেন। তারপর বলেন, ‘পাঁচ মিনিটের ইন্টারভিউ কিন্তু হয়ে গেল।’

না, না, এতে হবে না। একটা বড় ইন্টারভিউ চাই।

স্টিভ ওয়াহ জানতে চান, বেঙ্গালুরুতে কোন হোটেলে উঠব। ‘রিটজ্-কার্লটন’ শুনে বলেন, ‘আমিও ওখানেই উঠছি। তিন দিন থাকব। কোনো একটা সময় বসা যাবে।’

এক হোটেলে থাকলেই কি আপনাকে ধরা যাবে? আপনার নাগাল পাব কীভাবে? স্টিভ ওয়াহ আবারও হাসেন, ‘আপনি না সাংবাদিক! সাংবাদিকেরা ঠিকই পথ বের করে ফেলে।’

কথা বলতে বলতে গেটের কাছে এসে গেছি। বোর্ডিং পাস দেখিয়ে আমি তা পেরিয়েও গেলাম। কিন্তু স্টিভ ওয়াহ আটকে গেলেন! পিঠে ঝোলানো হ্যাভারস্যাকটায় লাগানো নিরাপত্তা সিল দেওয়া ট্যাগটা ছিঁড়ে গেছে। স্টিভ ওয়াহ সেটি তুলে দিলেন এয়ারলাইন্স কর্মীর হাতে। যা দেখে ওই তরুণের চোখ চড়কগাছ। ওটা কলকাতা বিমানবন্দরের ট্যাগ নয়। নিজেরটা ছিঁড়ে যাওয়ার পর সম্ভবত ভুল করে অন্য কারও ফেলে দেওয়া ট্যাগ তুলে এনেছেন স্টিভ ওয়াহ। ব্যাগটা তাই আবারও স্ক্যানিং মেশিনে পাঠানো হলো। আমি কাচের ওপাশে অপেক্ষা করছি। স্টিভ ওয়াহ চোখ দিয়ে ইশারা করলেন, ‘আপনি যান।’

বেঙ্গালুরু বিমানবন্দরে লাগেজ নেওয়ার সময় আবার দেখা হলো। কী আশ্চর্য, হোটেলে পৌঁছেই! ক্লাব লাউঞ্জে ব্রেকফাস্ট টেবিলে। বললাম, ‘আমি কিন্তু আপনার পিছু নিইনি। কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়ে যাচ্ছে।’
এবার স্টিভ ওয়াহকে অনেক আন্তরিক দেখাল। সঙ্গী ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ডিন হোনান—তাঁর কোম্পানির বিজনেস ম্যানেজার। বিকেল চারটায় ক্লাব লাউঞ্জেই কথা হবে বলেও প্রতিশ্রুতি দিলেন। সেই অনুযায়ী সেখানে গিয়ে বসে আছি। আমাকে হতাশ করে কিছুক্ষণ পর ডিন হোনান একাই এলেন। উদ্দেশ্য বোঝা গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। শ্রীলঙ্কা ও ভারতে শুরু করা ব্যবসা বাংলাদেশেও নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে স্টিভ ওয়াহর কোম্পানি। সেটি আগামী জুনের মধ্যেই। বাংলাদেশ সম্পর্কে একটু খোঁজখবর দরকার। স্টিভ ওয়াহর ইন্টারভিউয়ের আশায় আমিও সাগ্রহে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থা, অর্থনীতি এসব নিয়ে ‘জ্ঞানগর্ভ’ বক্তৃতা দিয়ে ফেললাম। কিন্তু স্টিভ ওয়াহ কোথায়?

ডিন হোনান জানালেন, ‘স্টিভ বলেছে, কাল ম্যাচের আগে আপনাকে সময় দেবে।’

মুখে বললাম, ‘ঠিক আছে। ঠিক আছে।’ মনে শঙ্কা, শেষ পর্যন্ত হবে তো! তারকাদের ইন্টারভিউ না হওয়া পর্যন্ত কোনো বিশ্বাস নেই।

দেখা যাক!

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×