কলম্বাস এই একটা দ্বীপই চিনবেন!

উৎপল শুভ্র

২ জুন ২০২১

কলম্বাস এই একটা দ্বীপই চিনবেন!

সাগরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্যারাবিয়ানের বেশির ভাগ দ্বীপ আবিষ্কারের কৃতিত্ব ক্রিস্টোফার কলম্বাসের। তবে এখন যদি আবার ফিরে আসেন তিনি, শুধু নাকি ডমিনিকাটাই চিনবেন। খুব একটা বদলায়নি। দ্বীপদেশটিতে এখনো পাহাড় আর বৃষ্টি-অরণ্যের রাজত্ব। ডমিনিকানরা তাই তাদের দ্বীপকে বলে `আনস্পয়েলড`। যেটির আরেক নাম `ন্যাচার আইল্যান্ড অব দ্য ক্যারারিয়ান`।

ক্রিস্টোফার কলম্বাস যদি আবার ফিরে আসেন এই ক্যারfবিয়ানে...। ফিরে এলে চিনতে পারবেন একদা তাঁর আবিষ্কৃত এই দ্বীপপুঞ্জকে? কীভাবে, কলম্বাসের সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ কি আর আছে!

একটা নাকি আছে। অজানা-অচেনা সব দ্বীপ ঘুরে শুধু একটা দ্বীপের কাছে এসেই নাকি কলম্বাস চিৎকার করে উঠবেন—চিনেছি! চিনেছি! ওই তো ডমিনিকা!

ডমিনিকার পর্যটন বিভাগের এমনই দাবি। প্রকৃতি যেভাবে সাজিয়েছে, ডমিনিকাকে যে সেভাবেই রেখে দেওয়া হয়েছে। ওরা বলে-আনটাড ন্যাচার। ডমিনিকার আরেক নামও তাই 'ন্যাচার আইল্যান্ড অব দ্য ক্যারাবিয়ান।'

একেবারে ‘আনটাচ্‌ড' তো অবশ্যই নয়। বাড়িঘর বানাতে হয়েছে। রাস্তাঘাট। দ্বীপের এক কোণে বড় এয়ারপোর্টটা ছাড়াও রাজধানী শহরের কোলে ছোট্ট আরেকটা। যেখান থেকে ছয় আসনের ছোট্ট ছোট্ট বিমান আশপাশের দ্বীপে উড়ে যায়। তবে যেটুকু না করলেই নয়, করা হয়েছে সেটুকুই মাত্র ৬০ হাজার লোকের বাস এই দেশে। বসতি শুধুই সমুদ্র উপকূল ঘিরে। বাকিটুকু ঘন সবুজ অরণ্য। আর সেই অরণ্যের মাঝে নদী আর নদী।

যেকোনো দেশে প্রথমে নামার পর এয়ারপোর্ট থেকে শহরে আসার ট্যাক্সি ড্রাইভার সে দেশ সম্পর্কে জানার প্রথম মাধ্যম। আর এখানে তো যাত্রাপথটা এক ঘণ্টারও বেশি। গ্যারি আলেকজান্ডার তাই ডমিনিকা সম্পর্কে বড় একটা বক্তৃতা দেওয়ারই সুযোগ পেয়ে গেলেন। বৃষ্টি অরণ্যের দেশ—এটা জানাই ছিল। নতুন জানলাম, এটা নাকি নদীরও দেশ। আচ্ছা, আচ্ছা, তাই নাকি! ছোটবেলায় পড়া রচনার লাইন তখন মনে গুঞ্জরিত, ডমিনিকা একটি নদীমাতৃক দেশ।

ডমিনিকায় ৩৬৫টা নদী। বেশ কয়টা রাস্তাতেই পড়ল। সবচেয়ে যেটা বড়, সেই লেইও-ও। ছ্যা, এর নাম নদী! পদ্মা-মেঘনা-যমুনার দেশের মানুষকে তুমি নদী চেনাচ্ছ হে!

পাথরের ওপর দিয়ে কুলকুল শব্দে যে স্রোতস্বিনী বয়ে যাচ্ছে, প্রস্থে তা বড়জোর হাত পাঁচেক হবে। এক পাশের বঙ্গোপসাগর দিয়ে ডমিনিকার সঙ্গে লড়া সম্ভব নয়। এই দ্বীপের পূর্বদিকে আটলান্টিক মহাসাগর। ক্যারিবিয়ান সাগর পশ্চিমে। পাহাড়েও সুবিধা করা যাবে না। তবে নদী নিয়ে যদি কথা বলতে চাস্ তো আয় দেখি! আলেকজান্ডারকে তাই বাংলাদেশে নদী কাহাকে বলে ও কত প্রকার তা বুঝিয়ে দিয়ে বললাম, 'তোমাদের সবচেয়ে বড় নদী তো আমাদের দেশে খালের মর্যাদাও পাবে না হে!' পদ্মা-মেঘনা-যমুনার এ পাড় থেকে ও-পাড় দেখা যায় না শুনে মহাবিস্মিত আলেকজান্ডার বললেন, 'তাহলে তো ওসব সাগর!'

লেইওর তুলনায় তো অবশ্যই। একটা দিকে অবশ্য খালরূপী ডমিনিকার নদীগুলো এগিয়ে। স্ফটিক স্বচ্ছ জল, যা নিশ্চিন্তে পানও করা যায়। গ্যারি আলেকজান্ডার অবশ্য দাবি করলেন, দুই পাহাড়ের চাপে লেইও এখানে এমন ক্ষীণতনু হয়ে গেছে। কোনো কোনো জায়গায় তা আরও অনেক বেশি চওড়া। আমি আর কথা বাড়ালাম না। পদ্মা-মেঘনা-যমুনাকে তুই পাহাড় দিয়ে চেপে ধরার চেষ্টা করে দেখ্ না!

ক্যারিবিয়ানের দ্বীপগুলোর মধ্যে ডমিনিকার অনন্যতার যে দাবি, সেটি অবশ্য আপনাকে মানতেই হবে। সবগুলো দ্বীপেরই আলাদা কোনো না কোনো বৈশিষ্ট্য আছে, তবে মোটামুটি একটা মিল তো পাওয়াই যায়। সেই সাগর, সেই সৈকত, সেই পাহাড়...। ডমিনিকানরা অবশ্য সেন্ট ভিনসেন্ট-গ্রেনেডায় পাহাড় দেখেছি বললে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে, 'ওগুলোকে পাহাড় বলে! ওসব তো টিলা, পাহাড় দেখতে হলে আপনাকে আসতে হবে ডমিনিকায়।'

ডমিনিকায় পাহাড় আর পাহাড়...পাহাড়ের মাঝে সব বৃষ্টি-অরণ্য

কথাটা সত্যি। দেশটাই পাহাড় আর পাহাড়। যার অনেকগুলো আকাশছোঁয়াও। আরেকটা দিক থেকেও ডমিনিকা অনন্য। যদিও সেই অনন্যতা পর্যটন-বাণিজ্যে বড় একটা অন্তরায়ই। সমুদ্র সৈকতের কথা তুললেই ডমিনিকানরা চুপ। প্রকৃতি সবাইকে ভাগ-বাটোয়ারা করেই দেয়। এ কারণেই ডমিনিকা পাহাড় পেয়েছে, সৈকত নয়। দু-একটা ছোট যে সৈকত আছে, সেগুলোর বালি কুচকুচে কালো। সেগুলোতেও পাথর আর পাথর। নুড়ি থেকে শুরু করে ইয়া বড় বড় পাথর।

প্রকৃতিকে তার মতোই রেখে দেওয়ার যে দাবি, অন্য দ্বীপগুলোর কাছে সেটির জবাবও আছে। ডমিনিকানরা তাদের দেশকে বলে, ‘আনস্পয়েল্‌ড', বাজান-ট্রিনিরা 'আনডেভেলপড'। কথাটা বোধ হয় একেবারে মিথ্যেও নয়। নির্ভেজাল প্রকৃতিপ্রেমিক হলে তবেই পর্যটকেরা গুচ্ছের টাকা খরচ করে এখানে আসবে। বিনোদনের আর কিছুই যে তেমন এখানে নেই। জেনে অবাক হবেন, ডমিনিকার কোনো নিজস্ব টেলিভিশন নেই! টেলিভিশন ছাড়লেই সব আমেরিকান চ্যানেল। বলার মতো কোনো নাইট ক্লাব নেই, এমনকি একটা সিনেমা হলও না। সিনেমা হল নাকি একটা ছিল, কয়েক বছর ধরে বন্ধ।

ডমিনিকাও দ্বীপ, তাই সি বিচও আছে, কিন্তু সৈকতে সব কালে বালি

রাজধানী শহর রসো (ওরা উচ্চারণ করে 'রজো') হেঁটেই ২০ মিনিটে পুরোটা চক্কর দিয়ে আসা যায়। মাত্র পাঁচ হাজার লোকের বাস এই শহরে। একটা রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কেন্দ্রে যা যা অপরিহার্য, এর সবই আছে। তবে তার সবই যেন মিনিয়েচার। মূল কাজে হাত দেওয়ার আগে স্থপতির উপস্থাপিত নকশা

২৪ জুলাই, ২০০৯। ডমিনিকা।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×