...আম কুড়াতে সুখ

উৎপল শুভ্র

৫ জুন ২০২১

...আম কুড়াতে সুখ

আপনি আম খেতে পছন্দ করলে চোখ বুঁজে ওয়েস্ট ইন্ডিজ চলে যেতে পারেন। অনেক খরুচে হয়ে যাবে ব্যাপারটা, তবে একবার সেখানে যেতে পারলে আম খাওয়া নিয়ে আর ভাবতে হবে না। বিভিন্ন দ্বীপে দেখবেন, গাছের নিচে অসংখ্য পাকা আম পড়ে আছে, নেওয়ার মানুষ নেই। সবারই যে অফুরন্ত আছে। সেন্ট ভিনসেন্ট থেকে গ্রেনাডা হয়ে ডমিনিকায় গিয়েও একই ঘটনা দেখার পর এ নিয়ে লিখেছিলাম লেখাটা।

প্রাণভরে (নাকি পেটভরে) আম খেতে চান? তাহলে রাজশাহীতে যান। টাকাপয়সা বেশি থাকলে ক্যারিবিয়ানেও আসতে পারেন।

আহ্হা, চটছেন কেন? প্রস্তাবটা একটু অবাস্তব হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছি। বাংলাদেশ থেকে ক্যারিবিয়ানের নিকটতম দেশে আসতেও প্লেনের টিকিট দুই হাজার ডলারেরও বেশি। আর আম খেতে আপনাকে আমি এখানে আসতে বলছি?

আহ্হা, শুধু আম খেতে আসবেন কেন? নীল সাগর দেখবেন, ক্যাটামারানে সাগরে ঘুরে বেড়াবেন, কোথাও যেতে ইচ্ছে না করলে গায়ে রোদ মেখে শুয়ে থাকবেন রুপালি সৈকতে...এটা অবশ্য একটু অত্যাচারই হয়ে যাবে! তুষারপাতের দেশের মানুষ রোদের জন্য আদেখলেপনা করতে পারে, আমাদের কি রোদের অভাব নাকি! রোদ তো আমাদের জন্য অত্যাচারই।

গ্রেনাডার সবচেয়ে বিখ্যাত সৈকত গ্র্যান্ড আনসে ছিল আমার রুমের দুয়ারেই। টেস্ট চার দিনেই শেষ হয়ে যাওয়ায় পঞ্চম দিনে একটা চক্কর দিতে গেলাম। আসলেই খুব সুন্দর। রুপালি বালির সৈকত নীল সাগরে মিশে যাওয়ার জায়গাটা তো অপূর্ব। বেড়াতে এলে মানুষ খুব আন্তরিক হয়ে যায়। বালিতে তোয়ালে পেতে শরীরের যে অংশটা না ঢাকলেই নয়, তা ঢেকে শুয়ে থাকা অচেনা-অজানা নারী-পুরুষ হাসিমুখে হাই-হ্যালো বলছে। সঙ্গে একটা কথা কমন-হোয়াট আ লাভলি ডে!

‘লাভলি ডে', কারণ ফাটাফাটি রোদ উঠেছে। ফাটাফাটিই-রোদে গা পুড়ে যাচ্ছে, পায়ের নিচে বালিও কম যাচ্ছে না। সূর্যের চেয়ে বালি গরম-প্রবাদটার জন্ম আর এমনিতেই নয়! বালিতে প্রতিফলিত সূর্যের আলোতে তাকিয়ে থাকাই কঠিন। শীতের দেশের মানুষের কাছে এটাই অফুরান আনন্দের উৎস। রোদে পুড়িয়ে শরীর নাকি তামাটে করতে হবে। বঙ্গদেশীয় মানুষদের সেই ঝামেলা থেকে ঈশ্বর একদমই মুক্ত করে দিয়েছেন। আমাকে তো আরও বেশি। পৃথিবীতে পাঠানোর আগেই চামড়া পোড়ানোর কাজটা নিজের হাতে নিয়ে একটু বরং বেশিই করে ফেলেছেন। রোদে পুড়ে কালো হয়ে যাওয়ার ভয় থেকে আমি তাই পুরোপুরি মুক্ত। তার পরও গ্র্যান্ড আনসে বিচের রোদ থেকে যে একরকম পালিয়ে বাঁচলাম, সেটিকে বলতে পারেন কালোতর হয়ে যাওয়ার ভয়ে!

গ্রেনাডার গ্র্যান্ড আনসে বিচ। যে রিসোর্টে ছিলাম, সেটিও এই নামেই

ক্যারাবিয়ানে শীতকাল বলতে কিছু নেই। দুটিই ঋতু-গ্রীষ্ম আর বর্ষাকাল । তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রির নিচে নামেই না। ও হ্যা, আমের কথা বলছিলাম। আমের জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজে সারা বছরই বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস। বছরজুড়েই আম হয় এখানে। মৌসুমের সময়টায় একটু বেশি এই যা! এখন সেই সময়, গাছে গাছে লিচুর মতো থোড়া থোড়া আম।

আম গাছও যেন অফুরান। যেকোনো রাস্তায় যান, পাশে আমগাছের দীর্ঘ সারি। সেই গাছের নিচে তাকালে ছেলেবেলায় পড়া ছড়া মনে পড়ে যায়

ঝড়ের দিনে মামার বাড়ি আম কুড়াতে সুখ
পাকা আমের মধুর রসে রঙিন করি মুখ

ঝড় লাগবে না, ওয়েস্ট ইন্ডিজ আমার-আপনার কারও মামাবাড়ি হওয়াটাও কঠিন। তবে আম কুড়াতে এমন সুখের জায়গা পৃথিবীতে আর পাবেন না। যেকোনো আমগাছের নিচেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে আম। আম পেকে গাছের নিচে পড়ছে এবং সেখানেই পড়ে থেকে পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নেওয়ার লোক নেই।

ক্যারাবিয়ান দ্বীপদেশগুলোতে গাছের নিচে এমন আম পড়ে থাকে

কারণ কী? ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা কি আম খায় না নাকি! খায়, তবে সবার বাড়িতেই দুই-তিনটা আমগাছ আছে। সেটির আম খেয়েই তো শেষ করতে পারে না ওরা। কিন্তু বাজারে যে আম দেখি, কখনোবা রাস্তার পাশে ছোট্ট টেবিলে সাজানো ছোট্ট ফলের দোকানেও। খোঁজখবর নিয়ে জানলাম, ওসব বিশেষ জাতের আম। নাম টেবল ম্যাংগো।

গ্রেনেডা গ্র্যান্ড বিচ হোটেলের বাগানে বেশ কয়েকটা টেবল ম্যাংগো গাছ ছিল। বুকসমান উচ্চতার গাছ, লম্বা বোঁটায় ঝুলে থাকা আম প্রায় মাটি ছুঁয়েছে। নিচে অবশ্য পড়ে-টড়ে নেই। তা থাকত হোটেলের সামনে বড় দুই-তিনটা গাছের নিচে। সবুজ ঘাসে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পাকা আম যেন হলুদ ফুল ফুটে আছে! সেন্ট ভিনসেন্টে এই দৃশ্য দেখে এসেছি, গ্রেনেডাতেও -দেখছি এসে ডমিনিকাতেও গ্রেনেডায় একদিন চার-পাঁচটা কুড়িয়েও এনেছিলাম। ব্যতিক্রমী এই দৃশ্য দেখে হোটেলের এক কর্মচারী হাসতে হাসতে বলল, এই আম তো খেতে ভালো নয়। আমি তো খারাপ কিছু পেলাম না। দারুণ মিষ্টি-একটু আঁশ বেশি এই যা! ডমিনিকার ফল বিক্রেতা অবশ্য গাছের নিচে পড়ে থাকার পরও তা বিক্রি হওয়ার অন্য ব্যাখ্যা দিল। অনেকের গাছের নিচে আম কুড়ানোর সময় নেই। কারও কারও কাছে তা অসম্মানজনক বলেও মনে হয়। তিনি নিজে যে আম নিয়ে বসেছেন, সেসব গাছের নিচ থেকে কুড়িয়ে আনাই।

টেবল ম্যাংগো গাছ...আম পাড়তে গাছে ওঠার দরকার পড়ে না

গত শুক্রবার বাংলাদেশের এক দিনের প্রস্তুতি ম্যাচ দেখতে রজো থেকে ত্রিশ মাইল দূরের পোর্টমাউথ শহরে যেতে হলো। উঁচুনিচু-আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তায় এক ঘণ্টা লাগে যেতে। কখনো দুই পাশেই পাহাড়। কখনোবা পাহাড় একটা পাশ ছেড়ে দিয়েছে সাগরকে। প্রায় পুরো রাস্তাতেই পাশে পাশে থাকল কৃষ্ণচূড়ার সারি। কৃষ্ণচূড়ার রংটাও যেন এখানে বেশি লাল। ক্যারিবিয়ানে কৃষ্ণচূড়াকে বলে ফ্ল্যাম্বোয়্যান্ট। আমরা যেটিকে রাধাচূড়া বলি, সেই হলুদ ফুলেরও দেখা মিলল। তবে সেন্ট ভিনসেন্টে যেমন একটা সাদা কৃষ্ণচূড়াও দেখেছি, সেটি নাকি ডমিনিকায় নেই ।

ছোট্ট পোর্টসমাউথ শহরটা ছবির মতো সাজানো-গোছানো। রাজধানী রজোর চেয়েও আমার অনেক বেশি ভালো লাগল। কারণটা অবশ্য জানলাম বদরুজ্জামানের কাছ থেকে। উনি আবার কে? উনি বাংলাদেশের এক ভদ্রলোক। ১৩ বছর ধরে ডমিনিকায় আছেন। এর আগে ৯ বছর ছিলেন গ্রেনেডায় । পোশাকের ব্যবসা করেন, রজো আর পোর্টসমাউথে দুটি মনিহারি দোকানও আছে। ডমিনিকায় অপ্রত্যাশিতভাবে তাঁর দেখা পেয়ে এখানে। দিনগুলো খুবই ভালো কাটছে। শুক্রবারই যেমন নিজের গাড়িতে করে পোর্টসমাউথে নিয়ে গেলেন নিয়ে এলেন। পোর্টসমাউথে যে রস ইউনিভার্সিটির মেডিকেল স্কুল, যাওয়ার আগেই জেনেছি তাঁর কাছ থেকে। তিনতলা-চারত লা ঝকঝকে বাড়িতে সাজানো ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসই বদলে দিয়েছে পোর্টসমাউথকে। আমেরিকায় কি ডাক্তারি পড়ার ব্যবস্থা নেই নাকি? অবশ্যই আছে, তারপরও ডাক্তার হতে এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে আমেরিকানদের পাড়ি জমানোর কারণ, এখানে বিদ্যাটা অনেক কম দামে কেনা যায়।

পোর্টসমাউথের ফোর্ট শার্লি, যা দেখতে গিয়ে গাছের নিচে পড়ে থাকা আম কুড়িয়ে খেয়েছিলাম

পোর্টসমাউথ যাওয়ার পরও অনেক আমগাছ আর তার তলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা হলুদ আম দেখেছি। লোভও লেগেছে, কিন্তু হাতে সময় নেই। তা পেলাম খেলা শেষে । মাঠের কাছেই পুরাকীর্তিতে রূপ নেওয়া ফোর্ট শার্লি দেখতে গিয়ে গাছের তলা থেকে দুটি আম কুড়িয়ে তার সদ্ব্যবহার করলাম । ফোর্ট শার্লিটা নিয়ে লেখার ইচ্ছে ছিল। জায়গায় কুলোচ্ছে না। শুধু এটুকু জানাই, এটাও সেই শার্লি এই দ্বীপ নিয়ে ফরাসি আর ইংরেজদের মারামারির ইতিহাস বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে।

ফোর্ট শার্লির আমও যথারীতি খুব মিষ্টি। আম যে মিষ্টি না হয়ে টকও হতে পারে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মানুষ তা জানেই না। এখানে টক আম বলতে কিছু নেই সবকিছু বুঝিয়ে বললাম। এখন আম খেতে আপনি রাজশাহীতে যাবেন না আসবেন এই ওয়েস্ট ইন্ডিজে-এটা ভাই আপনার সিদ্ধান্ত!

জুলাই ২০০৯, ডমিনিকা

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×