ক্যারিবীয় কড়চা

বানরের দ্বীপ!

উৎপল শুভ্র

১৭ জুন ২০২১

বানরের দ্বীপ!

সেন্ট কিটস আর নেভিস দুই দ্বীপ মিলে একটা দেশ। রোমান্টিক দ্বীপ হিসেবে খু্ব খ্যাতি আছে দুটিরই। আরেকটা বিচিত্র পরিচয়ও আছে সেন্ট কিটসের। বানরের দ্বীপ! এই দ্বীপে যে মানুষের চেয়ে তিন গুণ বেশি বানর!

আর সব দ্বীপের মতো সেন্ট কিটসেরও দাবি, এটিই ক্যারিবিয়ানের সুন্দরতম দ্বীপ। সেটি প্রতিষ্ঠিত করা কঠিন হয়ে গেলে তখন তুলে ধরা হয় নেভিসের দাবি। সাগরে মাইল আড়াই দূরত্বের পুঁচকে ওই দ্বীপটা ‘ধনী আর বিখ্যাত’ অনেকেরই ছুটি কাটানোর প্রিয় জায়গা। সেই সূত্রে নেভিসও খুব বিখ্যাত । পর্যটকদের কাছে আকর্ষণের দিকে থেকেও সেন্ট কিটসের চেয়ে বোধ হয় একটু এগিয়েই।

বড় ভাই দ্বীপ আর ছোট ভাই দ্বীপে অবশ্য খুব বেশি মিল-মহব্বত নেই। নানা বৈষম্যের অভিযোগ তুলে নেভিস প্রায়ই বড় ভাইয়ের সঙ্গে পৃথকান্ন হয়ে যাওয়ার হুমকি দেয়। কয়েক বছর আগে এ নিয়ে গণভোটও হয়েছিল। অল্পের জন্য দুই-তৃতীয়াংশের মতো পাওয়া যায়নি বলে নেভিস এখনো সেন্ট কিটসের সঙ্গেই আছে।

আলাদা হয়ে গেলে নেভিস হবে ভ্যাটিকানের পর দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম রাষ্ট্র। দুই দ্বীপ মিলেও তো এটি আমেরিকার সবচেয়ে ছোট দেশ। আয়তনের দিক থেকে যেমন, তেমনি জনসংখ্যার দিক থেকেও আয়তন ৬৮ বর্গমাইল, তবে জনসংখ্যাটা দেখছি এখানে নির্মলেন্দু গুণের কবিতার বই-কবিতা, তুমি অমীমাংসিত রমণী!

এখানে কবিতা মানে সেন্ট কিটস আর নেভিস, আর রমণী জনসংখ্যা! ইন্টারনেটে কোথাও ৩৫-৩৬ হাজারের বেশি পাচ্ছি না। কিন্তু যাঁর সঙ্গেই কথা হচ্ছে, তিনি বলছেন ৪৫ হাজার। নাকি ইন্টারনেটে শুধু সেন্ট কিটসের জনসংখ্যার কথা লেখা। তাহলে মেলে, কারণ নেভিসের হাজার দশেক লোকের বাস।

ছবিটা দেখুন: সেন্ট কিটস আর নেভিসকে এক সঙ্গে দেখলে টেনিস র‍্যাকেট আর বলের সঙ্গে মিল খুঁজে পাবেন। শুধু সেন্ট কিটসের গিটারের সঙ্গে। ছবি: এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা

সেন্ট কিটস লম্বাটে, নেভিস প্রায় গোল। মানচিত্রে তাই এই দুই দ্বীপকে দেখায় টেনিস র‍্যাকেট আর বলের মতো। আবার শুধু সেন্ট কিটস দেখুন—মনে হবে একটা গিটার। এটা তো আর এমন কিছু নয় যে, তা পর্যটন-বাণিজ্যে হাতিয়ার হতে পারবে। নিজেদের আলাদা করে চেনাতে সেন্ট কিটসের স্লোগানটা অন্য পৃথিবীর সবচেয়ে রোমান্টিক দ্বীপ। হানিমুন করতে তো এখানে প্রচুর নবদম্পতি আসেন, বিয়ে করতেও আসেন অনেকে। বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ দুই দল এবং এই সিরিজ-সংশ্লিষ্ট সবার মতো আমিও যে হোটেলে আছি, সেই সেন্ট কিটস ম্যারিয়েট রিসোর্ট অ্যান্ড রয়্যাল ক্যাসিনোতে একজন বিয়ে পরিকল্পককেও (ওয়েল্ডিং প্ল্যানার) নিয়োগ দেওয়া আছে এ জন্য।

এই হোটেলের পাশে রুপালি সৈকতটা বর-কনের খুব পছন্দ। এখানে প্রচুর বিয়ে হয়। গত বুধবার চেক-ইন করার সময়ই পরিচয় হলো বিয়ে করতে আসা এক আমেরিকান ভদ্রলোকের সঙ্গে। উনিও চেক-ইন করছেন। দেখে মনে হলো, বয়স চুয়ান্ন-পঞ্চান্নর নিচে হবে না।

পাশে দাঁড়িয়ে কনে। যাকে দেখে 'বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা' কথাটা মনে পড়ে গেল । পশ্চিমা মেয়েদের দেখে বয়স অনুমান করা কঠিন। তবে ওই মেয়েটা ২২-২৩-এর বেশি হবে না, এটা নিয়ে বাজি ধরে ফেলতে পারি।

রোমান্টিক দ্বীপ, হানিমুনের দ্বীপ, বিয়ের দ্বীপ-এসব বাড়তি দাবি। অন্য সব দ্বীপের মতো নীল সাগর, রুপালি সৈকত, আগ্নেয় পাহাড়...এসব তো আছেই। সেন্ট কিটসের লোকজন রাজি হবে না, তবে নিজেদের অনন্যতা বোঝাতে ওরা এটির নাম দিয়ে দিতে পারে বানরের দ্বীপ!

সেন্ট কিটসে এমন দৃশ্য খুব কমন। মানুষের চেয়ে বানর যে তিন গুণ বেশি! ছবি: গেটি ইমেজেস

ক্যারিবিয়ানের আর কোনো দ্বীপে এত বানর নেই। মানুষ যত, তার প্রায় তিন গুণ বানর! এখানকার বিখ্যাত গলফ কোর্সে নাকি বানরেরা খুবই সমঝদার দর্শকের ভূমিকায় থাকে। ব্যাপারটা আতহার আলী খানের কাছ থেকে যাচাই করে নিতে হবে। টনি কোজিয়ার যেমন 'ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের কণ্ঠস্বর' তেমনি বিশ্ব ক্রিকেটে ক্রমেই বাংলাদেশের ক্রিকেটের কণ্ঠস্বর' হয়ে ওঠা আতহার গলফ খেলতে পাগল । সেন্ট কিটসের হোটেলে গলফ কোর্স আছে শোনার পর সফরের সেই শুরু থেকেই এখানে আসার দিন শুনছিলেন।

রিসোর্টটা এমনই বিশাল যে, এক হোটেলে থেকেও দেখা হওয়াটা কঠিন পাঁচতলার মূল ভবন আর এখানে-ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তিনতলার সব ভিলা। প্রথম দিন তো রিসেপশন থেকে রুমে আসতে দুবার পথ হারিয়ে ফেললাম (এখানে অবশ্য হোটেলের বিশালত্ব আর আমার পথ হারিয়ে ফেলার প্রতিভার যুগপৎ ভূমিকা)! আটটা রেস্টুরেন্ট, তিনটা সুইমিংপুল, গলফ কোর্স, টেনিস কোর্ট, কয়েক হাজার বর্গফুটের কনফারেন্স রুম-এমন আরও কত কিছু যে আছে! সেন্ট কিটস শহর দেখব কী, হোটেলটাই দেখে এখনো শেষ করতে পারিনি। আতহারের সঙ্গেও এখানে আসার পর আর

দেখা হয়নি। তবে বানর মহোদয়ের সঙ্গে হয়েছে।

গত পরশু হোটেলের পাশে কুঁড়েঘর আকৃতির ছোট ছোট ছাউনিতে সাজানো সৈকতে গিয়ে দেখি, একটা খুঁটির সঙ্গে ছোট্ট দুই বানরশিশু বাঁধা। বানরকে মিষ্টি বললে কেমন শোনাবে ঠিক বুঝতে পারছি না। বরং ইংরেজিতে ‘কিউট' বলি। বানর দুটি আসলেই খুব কিউট। পূর্বপুরুষদের ব্যাপারে আমাকে এমন আগ্রহী দেখে মালিক ছুটে এলেন। তাঁর পোষা বানরের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি দেখে খুশি হয়ে ছবি তোলারও প্রস্তাব দিলেন। ঠিক আছে, তুলি একটা ছবি। কিন্তু তাই বলে দুই কাঁধে বসিয়ে! বানরের মালিক তাতেই ক্ষান্ত হলেন না। দ্বিতীয় ছবিটা তোলার আগে একটাকে আমার মাথায় বসিয়ে দিলেন! দুষ্টুমি করে বললাম, এই ছবির ক্যাপশন কী হওয়া উচিত। জানো-বড় বানরের সঙ্গে ছোট দুই বানর! লোকটা ক্যাপশন বলতে কী বুঝল কে জানে, হাসি দিয়ে বলল, "না, আমার কোনো বড় বানর নেই। ছোট এই দুইটা বাচ্চাই।'

সারল্যের হাসি দেখে পশুপ্রেমী লোকটাকে খুব ভালো লেগে গেল। একটু পরেই সেই ভালো লাগায় বড় একটা ধাক্কা লাগল, যখন বানরের সঙ্গে ছবি তোলার জন্য ১০ ডলার দাবি করে বসলেন। এটাই নাকি রেট! ওরে, তুমি তাহলে ব্যবসা করতে এখানে বানর নিয়ে বসে আছ! কী আর করা, দিতে হলো ১০ ডলার। বানর দুটি কুতকুতে চোখে তাকিয়ে আছে, ওদের কাছে আর ছোট হতে পারি না!

২ আগস্ট ২০০৯। সেন্ট কিটস।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×